অটোপাসেই শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি!
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
একের পর এক অটোপাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাক্ষেত্রে এ ধারা অব্যাহত থাকলে ছেলে-মেয়েরা আগামীতে পড়ালেখার ব্যাপারে আগ্রহ হাড়াবে। তাই এখনই এ বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী উঠেছে।
গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বাতিলের দাবিতে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের সামনে বিক্ষোভ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। এ সময় তারা সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসির ফল ‘বৈষম্যহীন’ দাবি করে নানা স্লোগান দেন। এর আগে নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল সহকারে শিক্ষার্থীরা বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের সামনে অবস্থান নেয়।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জানান, এইচএসসির বাতিল ছয়টি পরীক্ষা যে পদ্ধতিতে ম্যাপিং করে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে, তাতে চরম বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে ঘোষিত ফলাফল বাতিল করে নতুন পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। এতে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের শেষের দিকে মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছিলো সরকার। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকটাই পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হলেও পড়ালেখার পরিবেশ স্বাভাবিক ছিলোনা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরবর্তীতে স্কুল-কলেজগুলোয় নেওয়া হয়নি অতিরিক্ত ক্লাস। বরং আওয়ামী লীগ সরকার চালু করে অটোপাস। এতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ালেখা ছাড়াই পাস করে পাবলিক পরীক্ষায়ও।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের বারোটা বাজিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন সরকারের আমলে পড়াশুনা তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিল যা এখনও অব্যাহত আছে। করোনা বিদায় নেওয়ার পরও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চালু রাখেন সংক্ষিপ্ত সিলেবাস। ফলে পড়ালেখার আগ্রহ কমতে থাকে। চলতি বছর কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে বাকিগুলোয় অটোপাস দেওয়া হলেও আন্দোলন শুরু করেছেন এইচএসসিতে ফেল করা শিক্ষার্থীরা। করোনাকালে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয় ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হলেও বছরের পর বছর ধরেই এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমানে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা শুরু হয়। তখন ৩০টি এমসিকিউর মধ্যে দিতে হয়েছে ১৫টির উত্তর, যা শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের চোখে ছিল অবান্তর, অযৌক্তিক।
কারণ এমসিকিউতে এমনিতেই উত্তর বাছাই করার সুযোগ থাকে। সেখানে প্রশ্ন বাছাইয়ের বাড়তি সুযোগ দেওয়াকে হাস্যকর বলছেন শিক্ষাবিদরা। আওয়ামী লীগ আমলে এমন দায়সারা পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছাড়াই পাস করেছেন। পরীক্ষা বলতে যা বোঝায় তা একেবারেই ছিল অনুপস্থিত। বিগত সরকারের সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পড়াশোনার চাপ না থাকায় বড় পরিসরে শুরু হয় কিশোর অপরাধও। পাবলিক পরীক্ষায় ২০২১ সালে শুরু হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া। তখনো সব বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। তখন বিজ্ঞান বিভাগের জন্য বিজ্ঞানের বিষয়গুলো, মানবিক বিভাগে শুধু মানবিকের বিষয়গুলো আর বাণিজ্যে শুধু বাণিজ্যের বিষয়গুলোর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। ইংরেজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো পরীক্ষাই হয়নি। এরপর ২০২২ ও ২০২৩ সালে সংক্ষিপ্ত
সিলেবাসেই এসএসসি, এইচএসসিসহ সমমানের পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ বছরের এইচএসসিতেও সংক্ষিপ্ত সিলেবাস রাখা হয়েছিল। আর এ সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের বাতিল করতে সচিবালয় ঘেরাও করছিলেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত তা বাতিলও হয় ।
হাতেম আলী কলেজে পড়–য়া শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফাতেমা আক্তার মুন্নি বলেন, তার ছেলে মাধ্যমিকে বেশ ভালো পড়াশোনা করেছে। ফলাফলও মোটামুটি ভাল ছিল। কিন্তু আটোপাসের এই শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় পড়ে ছেলের পড়াশোনা শেষ। অনিয়মিত হয়ে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রমে। এছাড়া দেশের বর্তমান অটোপাস করার যে পদ্ধতি চালু হয়েছে তাতে করে সন্তানরা পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়মিত হওয়ার কারনে শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রনও কমে গেছে অনেকটা। এতে করে সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেধাবিরা। আর লেখাপড়ায় ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নিচ্ছে কম মেধাবীরা।
একই বিষয়ে শিক্ষক নেতা মহসীন উল ইসলাম হাবুল বলেন, অটোপাসের এই প্রাকটিস শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষক সকলের জন্যই ভয়ংকর একটি বিষয়। অটোপাশে অভ্যস্থ হয়ে পড়ায় নগরীর শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার মান হারাচ্ছে। একই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা তাদের শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে হারাচ্ছে নিয়ন্ত্রন। এই সিস্টেম অতিদ্রুত বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহন এখন সময়ের প্রয়োজন। একজন শিক্ষক হিসেবে তার সংগঠন বাকশিস এর পক্ষ থেকে অটোপাস সিস্টেম বন্ধে অতি শিঘ্রই আওয়াজ তোলা হবে।
এ ব্যাপারে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো: ইউনুস আলী সিদ্দিকী বলেন, ফলাফলে বরিশাল বোর্ড পূর্বের তুলনায় উন্নতি করেছে। এর পরেও কিছু কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। তাদের এ কর্মকান্ডে বহিরাগতদের ইন্ধন রয়েছে। যারা গতকাল শিক্ষাবোর্ডের সামনে এসেছিল তাদের দাবী সম্বলিত ব্যানারে বানান ভুল ছিল। এই ধরনের প্র্যাকটিস কখনোই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। যারা পাস করেছে তারা তাদের মেধার প্রতিফলনের ঘটিয়েছে। আর যারা অকৃতকার্য হয়েছে তারাও তাদের মেধা অনুযায়ী ফল লাভ করেছে। এর পরেও যেহেতু দাবী নিয়ে শিক্ষার্থীরা এসেছিল তাদের দাবিগুলো নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলবো এবং তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Post Comment