আগৈলঝাড়ায় সাদা পোশাকে র্যাবের অভিযান, গুলিতে কিশোরের মৃত্যু, আসলে কী ঘটল?
অনলাইন ডেক্স ।।
বরিশালের আগৈলঝাড়ায় র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানে হামলা ও গুলিতে এক কিশোরের মৃত্যু নিয়ে নানারকম তথ্য সামনে আসছে। র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে নিহত ছিয়াম মোল্লাকে ‘মাদক কারবারি’ বলা হলেও পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মাদক কারবারি তো দূরের কথা, কখনো মাদক সেবনও করেননি ছিয়াম।
হাসপাতালের রেকর্ড বইয়ে ছিয়ামের যে বয়স উল্লেখ করা হয়েছে তাতেও বড় ধরনের ঘাপলা রয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। হাসপাতালের রেকর্ড বইয়ে ছিয়াম মোল্লার বয়স ২২ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঢাকা পোস্টের হাতে আসা ছিয়ামের জন্মসনদে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। সে অনুযায়ী তার বয়স দাঁড়ায় ১৭ বছর।
২১ এপ্রিল গুলিতে ছিয়াম নিহত হওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন আরও একজন। তিনি হলেন রাকিব মোল্লা। র্যাবের ভাষ্যমতে রাকিব একজন ‘কুখ্যাত মাদক কারবারি।’ তবে ছিয়াম বা রাকিব কারও বিরুদ্ধেই আগৈলঝাড়া, গৌরনদী এবং উজিরপুর থানায় মাদক-সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। গুলিতে নিহত ছিয়াম মোল্লা ও গুলিবিদ্ধ রাকিব সর্ম্পকে মামাতো-ফুফাতো ভাই।
সাংবাদিকদের হাতে আসা কাগজপত্র অনুযায়ী রাকিব এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আর ছিয়াম গতবছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কারফা আইডিয়াল কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
কী ঘটেছিল সেদিন?
ঘটনার দিন আগৈলঝাড়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছিলেন, সাদা পোশাকধারী একদল লোক উপজেলার সাহেবের হাট এলাকায় গওহর হাওলাদারের বাড়ির সামনে গেলে সন্ত্রাসী ভেবে তাদের ওপর হামলা হয়। পরে জানা যায় তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। হামলা থেকে বাঁচতে গুলি ছুড়লে একজন নিহত হন এবং আরেকজন আহত হন। তবে অভিযানে কারা এসেছিল তা নিশ্চিত হতে পারিনি। যারা হতাহত হয়েছে এলাকায় তারা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
পরবর্তীতে স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা হলে আব্দুল্লাহ আল মামুনের কথার সঙ্গে তাদের কথার আংশিক মিল পাওয়া যায়।
সেদিনের পুরো ঘটনার একটা বর্ণনা পাওয়া যায় স্থানীয় তিনজনের কাছে। তবে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। এই তিনজনের কথায় সেদিনের যে চিত্র উঠে আসে তা হলো— আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী মোল্লাপাড়া গ্রামের জোরা ব্রিজ এলাকার মানিক মোল্লার চায়ের দোকানে টিশার্ট পরিহিত দুজন ব্যক্তি এসে এলাকার এক যুবককে টানা-হেঁচড়া করছিলেন। যাকে টানা-হেঁচড়া করা হচ্ছিল তিনি ‘ছিনতাইকারী’ বলে চিৎকার দিলে স্থানীয় অন্যরা এগিয়ে গিয়ে তাদের পরিচয় জানতে চান। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্থানীয় কয়েকজন সেই দুজনের ওপর হামলা করেন। এক পর্যায়ে দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন পিস্তল বের করে গুলি চালান। এতে ছিয়াম মোল্লা ঘটনাস্থলে মারা যান। রাকিব গুলি খেয়ে পাশের নালায় পড়ে যান।
ঘটনার অনেক পরে পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা সেখানে আসেন বলে জানান ওই তিনজনই। তাদের দাবি— ছিয়াম মোল্লা ও রাকিব মোল্লা কাছেই দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছিলেন।
এই তিনজনের কথা থেকে পুরো ঘটনায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সামনে আসে। তিনি হলেন যাকে টানা-হেঁচড়া করা হয়েছিল সেই যুবক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা-হেঁচড়া করা ওই যুবক হলেন ছিয়ামের প্রতিবেশী রুবেল মোল্লা; যিনি ঢাকায় থাকেন।
গুলিবিদ্ধ রাকিব মোল্লার মা মর্জিনা বেগম বলেন, আমরাও শুনেছি রুবেলের সাথে কারও ঝগড়া বেঁধেছিল। রুবেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিল রাকিব। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে গুলি ছুড়লে রাকিবের পেটে লাগে।
আগৈলঝাড়ায় রুবেলের বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। ঘরে ছিলেন তার মা আনোয়ারা বেগম ও দুই বোন আসমা আর সালমা। দুই বোনেরই বিয়ে হয়েছে। আসমা-সালমা জানান, রুবেলের সঙ্গে কারও ঝামেলা হয়েছে শুনে তারা দুই বোন বাবার বাড়িতে এসেছেন। এসে শোনেন রুবেল ঢাকায় চলে গেছেন।
কথা হয় নিহত ছিয়ামের চাচাতো বোন মীম আক্তারের সঙ্গে। উজিরপুরের ধামুরা ডিগ্রী কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মীম আক্তার বলেন, কারফা আইডিয়াল কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিয়াম। সেদিন আসরের আযানের পর ছিয়াম ঘর থেকে বের হন। ঠিক মাগরিবের আযানের আগে জোড়া ব্রিজ এলাকায় চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। অপরিচিত দুই ব্যক্তি এসে রুবেল মোল্লাকে জাপটে ধরেন। তখন সেখানে থাকা ছিয়াম, রাকিবসহ কয়েকজনের সঙ্গে ওই ব্যক্তিদের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর হঠাৎ করেই ওই ব্যক্তিরা তাদের সাথে থাকা পিস্তল বের করে এলোপাতাড়ি গুলি চালান। সেই গুলি গিয়ে ছিয়ামের বুকের ডান পাশ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তার সাথে থাকা ফুফাতো ভাই রাকিবুলের পেটের একাংশ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তখন সেখানে থাকা লোকজন দিগ্বিদিগ ছুটতে থাকেন। তারা গিয়ে ছিয়ামের পরিবারকে খবর দেন। গুলিবিদ্ধ ছিয়ামের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গৌরনদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান, ছিয়াম মারা গেছেন।
এদিকে গতকাল (মঙ্গলবার) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সীমান্তবর্তী দুই গ্রাম ঘুরে, অসুস্থ মানিক মোল্লা ছাড়া গ্রামে আর কোনো পুরুষের দেখা মেলেনি। ঘটনাস্থল থেকে অন্তত ৫০০ গজ দূরে ছিয়ামের বাড়িতে গিয়েও কোনো পুরুষকে পাওয়া যায়নি। ছিয়ামদের একান্নবর্তী পরিবার। তাদের বাড়ির এক উঠানে ১০টির বেশি ঘর রয়েছে। তবে কোনো ঘরে নারী আর শিশু বাদে কোনো পুরুষের দেখা মেলেনি।
দুটি মামলা করেছে র্যাব
আগৈলঝাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অলিউল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সরকারি কাজে বাধা দানের পাশাপাশি ৩৯৩ পিস ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় র্যাবের পক্ষ থেকে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জিআর মামলা নম্বর, ১২/২৪ এবং ১৩/২৫। র্যাবের ডিএডি সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার শেখ রিয়াজুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। সেখানে মাদক কারবারিদের হামলায় র্যাবের সদস্য অপেল মাহমুদ রাজীব ও আরিফুল ইসলাম শাকিব আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আহতরা বরিশালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে বা কেউ গ্রেপ্তার রয়েছেন কি না সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি ওসি।
গুলিবিদ্ধ রাকিব ও নিহত ছিয়াম মোল্লার বিরুদ্ধে থানায় আগে মাদকের কোনো মামলা ছিল কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে আগে কোনো মাদকের মামলার রেকর্ড নেই।
যা বলছে র্যাব
ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানকিভাবে এখনও কিছু জানায়নি র্যাব। তথ্য চেয়ে র্যাব-৮ পরিচালিত মিডিয়া সেলে এবং সরকারি নম্বরে ক্ষুদে বার্তা দিলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তবে দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, র্যাব সাদা পোশাকে সেখানে গিয়েছিল মাদক কারবারি আটক করতে। একজনকে আটক করেছিল। তখন তার সহযোগীরা র্যাবের কাছ থেকে আটককৃতকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং আভিযানিক টিমের ওপর হামলা চালায়। র্যাব আত্মরক্ষার চেষ্টা করে।
তিনি বলেন, আমাদের অভিযান এখনো শেষ হয়নি। অভিযান শেষ হলে প্রকৃত ঘটনা গণমাধ্যমে তুলে ধরা হবে।
র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। র্যাব সদর দপ্তর থেকে অর্ডার হয়েছে, তদন্ত কমিটি আজই গঠন করা হবে। তদন্ত সাপেক্ষে আসল ঘটনা বোঝা যাবে। আমরা যেটা জেনেছি সেটা হচ্ছে র্যাব মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হয়। একজনকে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। সে পুকুর থেকে গুলি চালায়। র্যাব সদস্য আহতও হয়েছেন এতে।
তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশ কার্যালয়ও ঘটনা তদন্ত করছে। আমরাও করছি। তদন্ত সাপেক্ষে যেই দোষী হোক আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র : ঢাকা পোস্ট,,,
Post Comment