Loading Now

ঘরে ঘরে ‘মৃত্যুবোমা’ এলপিজি!

অনলাইন ডেক্স ।।

দেশের বিভিন্ন জেলায় একের পর এক বাসাবাড়িতে ঘটছে এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। কখনো রান্নাঘরে, কখনো শোবার ঘরের পাশে রাখা সিলিন্ডার থেকে আগুন ছড়িয়ে মুহূর্তে পুড়ে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি, ছিন্নভিন্ন হচ্ছে পরিবার। দীর্ঘদিন ধরে পাইপলাইনে গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ থাকায় এলপিজির ওপর নির্ভরতা বাড়লেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির ঘাটতিতে বাড়ছে ঝুঁকিও। ঘরে ঘরে ‘মৃত্যুবোমা’ এলপিজি এখন রান্নাঘরের জ্বালানিতে পরিণত হয়েছে। নজরদারির অভাবে বাড়ছে বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি।

শহরকেন্দ্রিক ব্যবহারের পাশাপাশি এখন গ্রামগঞ্জেও ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে এলপিজি। কিন্তু জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই জ্বালানির বাজারে মান নিয়ন্ত্রণ, সেফটি চেক ও রিফিলিং প্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলা না থাকায় ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে ‘মৃত্যুদূত’।

বেসরকারি এলপিজি কোম্পানির রিফিলিং স্টেশনগুলোতে নিয়মিত সেফটি ইনস্পেকশন করা হয় কি না—তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। রেগুলেটর, হোসপাইপ, সিলিন্ডারের মেয়াদ কিংবা লিকেজ টেস্ট—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। ফলে একটি ছোট ত্রুটি থেকেই ঘটে যাচ্ছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

এদিকে বাজারে থাকা সব সিলিন্ডার যাচাই-বাছাইয়ের সক্ষমতা তাদের নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

নাম প্রকাশ না করে এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের জনবল ও প্রযুক্তি দুটোই সীমিত। তবু অভিযানে গেলে প্রাথমিক ত্রুটি অনেক পাওয়া যায়, বিশেষ করে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় একই চিত্র—সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক হয়ে ঘরে জমা হচ্ছে আর চুলা বা সুইচ অন করার সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। অনেক সময় বাচ্চারা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে, বয়স্কদের মৃত্যু হচ্ছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে।

দমকল বাহিনী বলছে, এলপিজিসংক্রান্ত দুর্ঘটনার হার গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেন, নিয়ম মেনে ইনস্টলেশন না করা, নকল রেগুলেটর, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার আর ব্যবহারকারীর অজ্ঞতার কারণেই ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে।

মানহীন সিলিন্ডারে বাড়ছে দুর্ঘটনা

দেশে নিবন্ধিত কয়েকটি বড় ব্র্যান্ডসহ অসংখ্য ছোট কোম্পানি অনুমোদন ছাড়া বাজারে সিলিন্ডার সরবরাহ করছে। অনেক সময় পুরনো ও স্ক্র্যাপ সিলিন্ডার রঙ করে বিক্রি করা হয়।

গবেষকরা বলছেন, তদারকি না থাকলে এই সেক্টর বিপজ্জনক পর্যায়ে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে রান্নাঘর থেকে শুরু করে দোকান, হোটেল কিংবা বাসাবাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার খুবই সাধারণ বিষয়। তবে কখনো কখনো এই সিলিন্ডারই হয়ে উঠে ভয়াবহ বিস্ফোরণের উৎস, যার ফলে অগ্নিকাণ্ড, দগ্ধ হয়ে মৃত্যু, ঘরবাড়ি ধ্বংস এমনকি প্রতিবেশীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। অথচ একটু সতর্ক থাকলেই এসব দুর্ঘটনা সহজেই এড়ানো সম্ভব।

ব্যবসায়ীরা জানান, সারাদেশে যে এলপিজি বিক্রি হয় সেই সিলিন্ডারগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। সিলিন্ডারের মুখের ভালব তো একেবারে গ্রাহকের ঘরেই থাকে। সেই দায়িত্ব গ্রাহককে নিতে হবে। সাধারণত দুই বছর পর পর ভালব বদল করা উচিত হলেও গ্রাহক বছরের পর বছর একই ভালব ব্যবহার করেন। এতে ভালবে ছিদ্র তৈরি হয় আর সেখান থেকে গ্যাস বের হয়ে ঘরের মধ্যে জমে থাকে। বদ্ধঘরে এভাবে গ্যাস জমে গেলে আগুনের সংস্পর্শে এলেই ঘটে দুর্ঘটনা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়েই এসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাদের মতে, দেশে যে সব দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য গ্রাহকদের সচেতন হওয়া জরুরি।

তার বলছেন, এলপিজি নিরাপদ জ্বালানি—কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষণ ব্যবস্থার অনিয়ম এটিকে ভয়ংকর করে তুলছে। সরকারকে দ্রুত সিলিন্ডার ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বলছে, লোকবল সংকটে থাকায় এলপিজির সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কোনো সেল কাজ করছে না। তবে এবিষয়ে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে।

বিইআরসি’র এক কর্মকর্তা জানান, সিলিন্ডারের মেয়াদ, রিফিলিং স্টেশন সেফটি এবং রেগুলেটরি স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে কঠোর নির্দেশনা আসছে। তবে বাস্তবায়নে সব সংস্থার সমন্বয় দরকার।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেন, এলপিজি দুর্ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। বাড়িওয়ালা হিসেবে সবসময় ভয় কাজ করে। কারণ আমার বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ বসবাস করেন। সিলিন্ডারে সমস্যা থাকলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি জানান, গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্বল তদারকি ও অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এলপিজি ব্যবহার। সরকারি-বেসরকারি কারও কার্যকর পদক্ষেপ নেই। কেন দুর্ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়েও সঠিক তথ্য নেই। উল্টো বিস্ফোরণের পর গ্রাহক, সরবরাহকারী ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পরস্পরের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের ২৪ নভেম্বর এক্সটেনশনে একটি খাবারের দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দোকানে স্বাভাবিকভাবে রান্নার কাজ চলছিল। এ সময় গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের মুহূর্তে আগুনের সংস্পর্শে সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়।

এর আগে ১৯ নভেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সিলিন্ডারের গ্যাসের আগুনে চারজন দগ্ধ হয়েছেন। গ্যাস সিলিন্ডারের নিচে ছিদ্র করার সময় হঠাৎ দ্রুতগতিতে গ্যাস বেরিয়ে পাশের চায়ের দোকানের আগুনে ছড়িয়ে পড়ে।

শুধু ঢাকা আর গাজীপুর নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ হয়ে মৃতুহারও কম নয়। গত সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আগস্টে গাজীপুরে এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

 

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

সঠিক ব্যবহার করলেই এলপিজি তুলনামূলক নিরাপদ। এজন্য—মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার না করা এবং নিয়মিত লিকেজ টেস্ট করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের পরামর্শ- সিলিন্ডার কখনো শোবার ঘর/বন্ধ জায়গায় না রাখা। ভালোমানের রেগুলেটর ও হোসপাইপ ব্যবহার করা৷ এছাড়া গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে চুলা, সুইচ, ইলেকট্রিক বোতাম অফ রাখা।

এদিকে এলপিজির নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিইআরসিতেও সিলিন্ডারের মান যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সেল নেই বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে, এটা সত্য। আমরা ছোট্ট একটি টিম নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছি। এখানে লোকবল খুবই কম। ফলে আমরা সে রকম তদারকি করতে পারছি না। তবে আমরা কোম্পানিগুলোকে এবিষয়ে চিঠি দেব যেন তারা সিলিন্ডারের মান নিশ্চিত করে। আমাদের একটি টিম ইতোপূর্বে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সঙ্গে কথা বলেছে। এছাড়া দুর্ঘটনা রোধে আমরা জনসচেতনতামূলক কাজ করছি।

সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণে কোনো সংস্থা না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন।

তিনি বলেন, সরকারের উচিত সবার আগে মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। প্রয়োজনে কোনো সংস্থার মাধ্যমে একটা স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা। সেই স্ট্যান্ডার্ড মানছে কি না তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। কোম্পানিগুলোকে জোর করতে হবে এই মান নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। নিয়ন্ত্রণ না করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করাও জরুরি।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, দেশের গ্যাস সরবরাহ ও সংযোগ কতটা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা-প্রাণহানি। গ্রাহকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার দিয়ে যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আর কোনো দায় নেই। এটা দুঃখজনক।

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED