জাতীয় নির্বাচন: ৬ মাসের টানাটানিতে ভোট
অনলাইন ডেক্স ।।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আগামী জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হবে। জুলাইয়ের ১ তারিখেও যাবে না। কিন্তু বিএনপির দাবি ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট হতে হবে। ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ব্যবধান ৬ মাস। এই ৬ মাসের দাবি ছাড়তে নারাজ উভয় পক্ষ। এ নিয়ে বাড়ছে বিরোধ। চলছে পাল্টিপাল্টি অভিযোগ। বিএনপি এটাও বলছে, ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট না হলে, ভোট আর কখনোই হবে না।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ১০ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় ভর করেছে বিএনপির মনে। সেই থেকে আস্থাহীনতায় কোনো ছাড় দিতে চাইছে না দলটি। সরকার পক্ষও তাদের অবস্থানে অটল থাকায় অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে দুই পক্ষ। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হচ্ছে।
জানতে চাইলে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকারের কাজের পরিধি কেবল নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ নয়। সরকারকে যেহেতু কিছু সংস্কার আর বিচারকাজও করতে হচ্ছে, তাই সরকার কোনো নির্দিষ্ট মাস না বলে একটি সর্বোচ্চ সীমা দিয়েছে এবং বারবার বলছে, নির্বাচন জুনের পরে যাবে না। সরকারের কিছু কাজ প্রণিধানযোগ্যভাবে এগিয়ে গেলে সরকার নিশ্চয়ই নির্বাচনের তারিখটি ঘোষণা করবে। এ বিষয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ আলোচনাসহ নানা ইস্যুতে সৃষ্ট অস্থির পরিস্থিতিতে চলতি মাসের মাঝামাঝি নড়েচড়ে বসে বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। এ পরিস্থিতিতে ২৪ ও ২৫ মে বিএনপিসহ দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। এসব বৈঠকে অধিকাংশ দলের পক্ষ থেকেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানানো হয়। বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ, জামায়াত সংস্কার ও নির্বাচন, এনসিপির পক্ষ থেকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানানো হয়।
বৈঠকের পর বিএনপির দিক থেকে আশা করা হয়েছিল, নির্বাচনের দিন-ক্ষণ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসবে। কিন্তু সেটা না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করে দলটি।
এ পরিস্থিতির মধ্যেই জাপান সফরে থাকা প্রধান উপদেষ্টার এক বক্তব্যে বিএনপির এ সংশয় আরও জোরদার হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার টোকিওতে এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের সব রাজনৈতিক দল নয়, কেবল একটি দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে।
প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যে হতাশার পাশাপাশি সরকারকে নিয়ে বিএনপির সন্দেহ-সংশয় আরও ঘনীভূত হয়েছে। দলীয় সূত্র বলছে, সংস্কার ও বিচারের নামে সরকার কালক্ষেপণ করে অন্য অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইছে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের জবাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি, দেখলাম ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব জাপানে বসে বিএনপির বদনাম করছেন। একটু লজ্জাও লাগল না দেশের সম্পর্কে বিদেশে বসে বদনাম করতে। তিনি বললেন, একটি দল নির্বাচন চায়। আর আমরা বলতে চাই, একটি লোক নির্বাচন চায় না। সে হলো ড. ইউনূস, উনি নির্বাচন চান না।’
সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘জুন মাসে যদি নির্বাচনের কথা বলেন, এই নির্বাচন কখনো বাংলাদেশে হবে না। নির্বাচন যদি করতে হয় ডিসেম্বরের মধ্যেই করতে হবে।’
এর আগে গত বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। পরদিন আরেক অনুষ্ঠানেও ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে আহ্বান জানান তিনি।
বিরাজমান সংকট নিয়ে নানা মত এসেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছ থেকে। তাঁদের অনেকের ধারণা, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত—সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্যের পর বিষয়টি জোরালভাবে সামনে এসেছে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল ছাড়া অধিকাংশ দলই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শারমীন আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় সংলাপ বা আলোচনার টেবিলে বসে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট করে নিলে (ডিসেম্বর থেকে জুন) দেশের রাজনীতিতে সংকটের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রশমিত হতে পারে।’
তবে বিরাজমান সংকট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। সেটা না হলে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে, আশঙ্কা, অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে।’
সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে অধ্যাপক মজিবুর রহমান আরও বলেন, উপদেষ্টা ও সরকারের দায়িত্বশীলদের নানা বক্তব্যের কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে, যাতে সরকার নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এত রকম অস্পষ্টতা না রেখে একেবারে পরিষ্কারভাবে বলে দিলেই হয় নির্বাচন কবে হবে, সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই হতে হবে।’
Post Comment