জুলাই সনদে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, বাস্তবায়নে নেই আইনি বাধ্যবাধকতা
অনলাইন ডেক্স ।।
জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ছিল সংস্কার। কমিশন গঠন, সুপারিশ পেশ এবং তারপর ঐকমত্য কমিশন গঠন। শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদ স্বাক্ষর হয়েছে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)।
জুলাই যোদ্ধাদের বাধার মুখে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের বাইরে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে জুলাই সনদে।
তবে এই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির অনুপস্থিতি সবচেয়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
দলটি বলছে, সনদের আইনগত ভিত্তি দেওয়া না হলে তারা স্বাক্ষর করবে না। জুলাই আন্দোলনে সম্মুখ সারির নেতাদের নিয়ে গঠিত দলটির অনুপস্থিতি সত্বেও বড় রাজনৈতিক দলগুলো সনদ স্বাক্ষর করায় সরকার স্বস্তির ঢেকুর তুলেছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করলেও কার্যত এটি একটি ‘রাজনৈতিক দলিল’ হিসেবে থাকছে। বাস্তবায়নের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত গড়াচ্ছে পরবর্তী সংসদের ওপরেই। তবে সেই সংসদে এই সনদ বাস্তবায়নের আসলে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নাই। এই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সাতটি বিষয়ে অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা। জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন না করা এবং উপরন্তু সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান। গত ১৬ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার এবং ২০২৪ এর জুলাই অভুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
প্রতিশ্রুতিতে আরও আছে, জুলাই সনদে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইন সমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন। সবশেষ ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কালক্ষেপন না করে অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যে অঙ্গীকার করেছে তার বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সংসদের উপস্থিতি অপরিহার্য। কারণ বর্তমান সংবিধানের আলোকে সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়ন দুটোই কেবল সংসদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। সংবিধান সংশোধন ব্যতিরেকে যেসব আইন বা বিধি অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা হচ্ছে সেসবও সংসদের প্রথম অধিবেশনে গৃহীত না হলে এমনিতেই বাতিল হয়ে যাবে।
এদিকে জুলাই সনদের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট (দ্বিমত) দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এই সনদে স্বাক্ষর সত্বেও দলটি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে ওইসব বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান কি হবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। অপরদিকে গণভোটের মাধ্যমে জামায়াতের মতো দলসমূহ যে বাধ্যবাধকতা পরবর্তী সংদের ওপর তৈরি করতে চাইছে সেটিও আসলে চূড়ান্ত নয়। কারণ গণভোটে সনদ গৃহীত হলেও জাতীয় সংসদে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে।
তাছাড়া স্বাক্ষরিত সনদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার হলো এই সনদের কোনো বিষয় আদালতে চ্যালেঞ্জ করবে না রাজনৈতিক দলগুলো। স্বাক্ষরকারী দলগুলোর এই প্রতিশ্রুতির আসলে কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক দলগুলো সেই অঙ্গীকার অনুযায়ী আদালতে চ্যালেঞ্জ না করলেও দেশের যেকোনো নাগরিক তা চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। যে কারণে এর আগে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী তিন থেকে চার দশক পরও উচ্চ আদালতে বাতিল হতে দেখা গেছে।
এমতাবস্থায় আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই সনদ আপাত দৃষ্টিতে একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে এর আসলে কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। খোদ রাজনৈতিক দলেও নেতারাও এমনটি মনে করছেন। জামায়াতপন্থি আইনজীবী শিশির মনির যিনি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন। বেরিয়ে এসে তিনি ফেসবুক পোস্টে লিখেন, সনদ বাস্তবায়নের জন্য ২/১ দিনের মধ্যে সুপারিশ পাঠাতে হবে। সুপারিশ প্রাপ্তির এক সপ্তাহের মধ্যে আদেশ জারি করতে হবে। বড় বিষয়ে নোট অফ ডিসেন্ট তুলে নিতে হবে। অন্যথায় এর ভবিষ্যত অনিশ্চিত।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব মনে করেন, এই ধরনের আদেশ জারির কোনো ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী এই সরকারের নেই। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধান তো বাতিল করা হয়নি। এমতাবস্থায় সাংবিধানিক আদেশ জারির কোনো বিধান সংবিধানে নেই। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকেও সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে কোনো আদেশ জারির ক্ষমতা দেয়নি। তদুপরি যারা এ ধরনের আদেশ জারির কথা বলছেন তারা আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছেন।
তাহলে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি কি জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, আমার দৃষ্টিতে এর আসলে আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এটা আসলে কোনো কিছুর আবরণ দিয়ে অন্য কিছুকে ঢেকে রাখার চেষ্টা। অনেকটা আইওয়াশ টাইপেরও বলা যায়।
সনদকে আদালতে চ্যালেঞ্জ না করার বিষয়টিকেও তাৎপর্যহীন মনে করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো একটা অঙ্গীকার করেছে তারা আদালতে এটা চ্যালেঞ্জ করবে না। তাদের ওপর এটা বাধ্যকর ধরে নিলেও ১৮ কোটি মানুষের ওপর তো আর তা বাধ্যকর নয়। কোনো নাগরিক যদি মনে করেন যে, জুলাই সনদে তার মৌলিক অধিকার খর্ব হয়েছে, তিনি অবশ্যই আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। কারণ এই সংবিধানে বলাই হয়েছে, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সবকিছু বাতিল হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংসদে জুলাই সনদকে গ্রহণ করলেও তা আদালতে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ অবশ্যই থাকবে।
সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী ইশরাত হাসান মনে করেন- জুলাই সনদ কেবলমাত্র নীতিনির্ধারণে দিকনির্দেশক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, “জুলাই সনদ ২০২৫”-এ যে অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা যদি কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে একটি নীতিগত ঘোষণা বা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে গৃহীত হয়, তবে এর কোনো বাধ্যতামূলক আইনগত ভিত্তি থাকে না। এটি কেবলমাত্র নীতিনির্ধারণে দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করতে পারে, যেমন সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে উল্লিখিত “রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি”-সমূহ, যেগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ নির্ধারণ করে কিন্তু আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
তবে আইনজীবী ইশরাত হাসান মনে করেন, যদি “জুলাই সনদ” ভবিষ্যতে সংবিধানের অংশ হিসেবে সংযোজন করা হয়, তবে তা এমনভাবে প্রণীত হওয়া উচিত যাতে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট ডিভিশনের রিট ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, এতে যদি এমন কোনো বিধান যুক্ত হয় যা নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রয়োগে বাধা দেয় বা সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট ডিভিশনের রিট ক্ষমতা সীমিত করে, তবে তা বাংলাদেশের মূল কাঠামো তত্ত্বের (Basic Structure Doctrine) সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। কারণ ১০২ অনুচ্ছেদ হাইকোর্ট ডিভিশনকে মৌলিক অধিকার রক্ষার সর্বোচ্চ সাংবিধানিক ক্ষমতা দিয়েছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বের একটি অপরিহার্য উপাদান। সংবিধানের কোনো অংশই এমনভাবে পরিবর্তন করা যায় না যাতে জনগণের অধিকার রক্ষার এই মৌল কাঠামো ক্ষুণ্ন হয়।
তথ্য সূত্র : বাংলা নিউজ,,,,
Post Comment