ঢালাও সাংগঠনিক ব্যবস্থায় ত্যাগীরাও ক্ষতিগ্রস্ত!
অনলাইন ডেক্স ।।
সারাদেশে বিভিন্ন অভিযোগে নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএনপি। শাস্তিমূলক এসব ব্যবস্থার মধ্যে আছে বহিষ্কার, পদাবনতি, শোকজ ও অব্যাহতি। তবে এই প্রক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রভাবশালী নেতাদের বিরাগভাজন হয়ে ক্ষেত্রবিশেষ নিরপরাধ ও ত্যাগী নেতাকর্মীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ, ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তদন্ত করা হচ্ছে না। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা শঙ্কায় ভুগছেন। দলের বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভও তৈরি হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যখন ‘সুদিন ফিরে এসেছে’, নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, তখনই নানা অজুহাতে দলীয় শাস্তির খড়্গের নিচে পড়তে হচ্ছে। নেতিবাচক কাজে ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা নেই এমন নেতাকর্মীরা বহিষ্কার হওয়ায় তাদের রাজনৈতিক জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এমন অনেকে প্রতিকার চেয়ে দলের কাছে আবেদন করেছেন।
বিএনপির দপ্তর থেকে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত নানা অভিযোগে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের তিন হাজার ২২৩ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মূল দল বিএনপির নেতাকর্মী রয়েছেন এক হাজার ৮০০ জন। তাদের মধ্যে ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে ছাত্রদলের প্রায় ৪০০ জন বহিষ্কার ও ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ; স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ নেতাকর্মী বহিষ্কার ও ১৫০ জন কারণ দর্শানো নোটিশ পেয়েছেন। যুবদলেরও দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলের কেন্দ্রীয় অফিস সূত্র জানা গেছে, ইতোমধ্যে সাংগঠনিক শাস্তি পুনর্বিবেচনা বা তুলে নেওয়ার জন্য প্রায় দেড় হাজার আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ আবেদন আছে যারা উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। তাদের অনেকের ক্ষেত্রে দলের স্থানীয় নেতারাও লিখিতভাবে কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত চালানো তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়া নেতাকর্মীর হার ১৩ শতাংশের বেশি।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বেশির ভাগ নেতাকর্মীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। অনেকে জানেনও না কী জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে দল। এমন নেতাকর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তারা এখন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিড় করা এমন কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একপক্ষকে ঘায়েল করতে মিথ্যা অভিযোগ তুলে বহিষ্কার করিয়েছে প্রভাবশালী গ্রুপ। অথচ এদের অনেকে বিগত আন্দোলনে মাঠে ছিল না।
২০ জুলাই নয়াপল্টনে কথা হয় বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার নেয়ামতি ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা আসাদুল্লাহ খানের সঙ্গে। হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বসে আছেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, গত ৮ মার্চ রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ নব্য বিএনপির কিছু লোক তাঁকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই ঘটনায় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সালাম মৃধাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যিনি এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
এ সময় পাশে থাকা সালাম মৃধা জানান, গত ১৬ বছরে তিনি চারবার কারাগারে গেছেন, ১১টি মামলা রয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল তা তিনি বুঝতে পারছেন না। এখন তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখে।
গত ৬ জুলাই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রাকিব উদ্দিন সরকার ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হালিম মোল্লাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। তাদের বিরুদ্ধে ওই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে দল থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা নেওয়ার কারণও জানতে পারেননি তারা।
রাকিব উদ্দিন সরকার জানান, ১২ বছর তিন মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। যেদিন তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এর কয়েকদিন আগে থেকে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এলাকার নেতাকর্মীরা জানান, পারিবারিকভাবে রাকিব সরকার ধনাঢ্য। নিজে ব্যবসায়ী। তাঁকে চাঁদাবাজের তকমা লাগিয়ে বহিষ্কার করা হয়েছে।
হালিম মোল্লা জানান, গত ২৮ জুন গাজীপুরে একটি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে হয়তো তাঁকে বহিষ্কার করা হতে পারে। অথচ ওই সংঘর্ষের দিন তিনি দলের কর্মসূচিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিলেন। ওই ঘটনার সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না।
এলাকার নেতাকর্মীরা জানান, হালিম মোল্লা কর্মীবান্ধব নেতা। এটা তাঁর জন্য কাল হয়েছে। দলে ফেরার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে রাকিব সরকার ও হালিম মোল্লা লিখিত আবেদন করেছেন।
হালিম মোল্লাকে বহিষ্কারের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, বিগত দিনে তাঁর বিরুদ্ধে ৪২টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। বিভিন্ন সময় কারাবরণকারী এই নেতার মতো সাহসী, ত্যাগী খুব কম আছে।
দলীয় কোন্দলেও অনেকের পদ যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পিরোজপুর জেলা যুবদলের আহ্বায়ক মারুফ হাসান, যুগ্ম আহ্বায়ক বদিউজ্জামান শেখ রুবেলকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় যুবদলের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা সমকালকে জানান, ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলেও একটি মহলের চাপে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। মারুফ হাসান যুবদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর অনুসারী ও ঘনিষ্ঠ। এটা তাঁর কাল হয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের অন্তর্গত তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা যুবদল নেতা কামাল হোসেন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আল আমিনও জানেন না তাদের কেন বহিষ্কার করা হয়েছে। সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে শোকজ করা হয়নি তাদের।
এসব অভিযোগে বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি তার স্বচ্ছ ইমেজ ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এর পরও দলকে নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে, টার্গেট করে অপ্রচার চলছে। তাই শৃঙ্খলা রক্ষায় শূন্য সহনশীলতা নীতিতে অটল দল। তবে তিনি স্বীকার করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝির কারণে কিংবা সংবাদমাধ্যমে অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ায় ক্ষেত্র বিশেষে নিরপরাধ নেতাকর্মীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব নেতাকর্মীর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে, তদন্ত চলছে। নির্দোষ হলে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে।
তথ্য সূত্র : সমকাল,,,,,,,
Post Comment