দারিদ্র্য বেড়ে ২৭.৯৩ শতাংশে!
অনলাইন ডেক্স ।।
তিন বছরে দেশে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। ২০২২ সালের বিবিএস-এর হিসাবে দেশে অতিদারিদ্র্য ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সেটি ২০২৫ সালে বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এছাড়া সাধারণ দারিদ্র্য হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের মাসিক আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় ধারদেনা করে চলছে সংসার। একটি পরিবারের খাবার কিনতে ব্যয় করতে হবে মোট আয়ের ৫৫ শতাংশ। পরিবারে আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা ব্যয় ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ঋণ পরিশোধে যায় ২৭ শতাংশ। বেড়েছে আয়বৈষম্য, আর স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। এছাড়া নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেখা দিয়েছে সবচেয়ে বড় সংকট।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) পরিচালিত সমীক্ষায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। সোমবার রাজধানীর আগারগাঁও এলজিইডি মিলনায়তনে ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজহোল্ড লেভেল ইন মিড-২০২৫’ শীর্ষক সমীক্ষা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে মূল বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি জানান, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গত মে মাসে ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর এই সমীক্ষা পরিবারগুলোর আয়, কর্মসংস্থান, ব্যয়, ঋণ-সঞ্চয়, ডিজিটাল অংশগ্রহণ এবং জীবনযাত্রার টানাপোড়েনকে নতুনভাবে চিত্রিত করেছে। সমীক্ষার দারিদ্র্য নিরূপণের পদ্ধতি উপস্থাপন করেন পিপিআরসির নামিরা শামীম এবং প্রশ্নত্তোর-পর্ব পরিচালনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ এম. হাসেমি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন ও মধ্যম শ্রেণির মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। তবে উচ্চবিত্তের আয়ের চেয়ে ব্যয় কম। এছাড়া বেড়েছে বৈষম্য। এক্ষেত্রে জাতীয় ব্যয় গিনি সহগ ২০২৫ সালে বেড়ে হয়েছে দশমিক ৪৩৬, যেটি ২০২২ সালে ছিল দশমিক ৩৩৪। এই বৈষম্য গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রেই বেড়েছে। আরও বলা হয়েছে, গত সরকার আমলে বা ২০২৪ সালের আগস্টের আগে যে কোনো সেবা পেতে ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ পরিবারকে ঘুস দিতে হতো। এখন সেটি কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে সার্বিকভাব ঘুস দেওয়া কিছুটা কমলেও বর্তমানে কোনো কাজ করতে গিয়ে ঝামেলা এড়াতে বেশি ঘুস দিচ্ছে মানুষ। ২০২৪ সালের আগস্টের আগে যেটি ছিল ২১ দশমিক ৫১ শতাংশ, সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ঘুস দেওয়া হয়েছে সরকারি অফিসে। এর পরে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের বেশি ঘুস দিতে হয়েছে।
দারিদ্র্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২২ সালের পর অর্থনীতি নানা ধরনের দুর্যোগের মধ্য দিয়ে গেছে। এর অন্যতম হলো উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাবে দরিদ্ররা তো প্রভাবিত হয়ই, আবার যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে, তারাও নিচে নেমে যায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলেও এখনো সাড়ে ৮ শতাংশের ওপরে, যা অতি উচ্চ বলা যায়। এদিকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি মজুরি হার। বরং সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়েনি। আবার যা আছে, সেখানে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ কম আয় থেকে বেশি আয়ের দিকে না গিয়ে বরং উলটোভাবে কৃষির মতো খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। এদিকে দরিদ্র পরিবারগুলোকে ওপরে টেনে তুলতে সরকারি যে কর্মসূচি, সেগুলোর আওতা ও অর্থের পরিমাণ কোনোটিই বাড়েনি। আবার যা চালু আছে, সেগুলোয়ও টার্গেটিং সমস্যা, দুর্নীতি এবং ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। সুতরাং স্বল্পমেয়াদে দারিদ্র্য কমাতে সরকারি কর্মসূচিগুলোর সম্প্রসারণ, টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হবে।
প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, গড়ে একটি পরিবারের মাসিক আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা এবং মাসিক ব্যয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। কিন্তু এর মধ্যে অনেক ভাগ রয়েছে। যেমন: সবচেয়ে নিচের দিকের ১০ শতাংশ মানুষের মাসিক আয় ৮ হাজার ৪৭৭ টাকা আর ব্যয় ১২ হাজার ২৯৪ টাকা। এছাড়া মধ্যবিত্ত ৪০ শতাংশ মানুষের আয় ২৮ হাজার ৮১৮ টাকা আর ব্যয় হয় ২৯ হাজার ৭২৭ টাকা। উচ্চস্তরে থাকা ১০ শতাংশ মানুষের আয় ১ লাখ ৯ হাজার ৩৯০ টাকা হলেও ব্যয় হয় ১ লাখ ১ হাজার ১৬৩ টাকা। এক্ষেত্রে তিন বছরের ব্যবধানে শহরের পরিবারের মাসিক আয় কমেছে; কিন্তু খরচ বেড়ে গেছে। শহরের একটি পরিবারের গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা। খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। অন্যদিকে গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। গ্রামের একটি পরিবারের গড় আয় ২৯ হাজার ২০৫ টাকা, খরচ ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। ২০২২ সালে গ্রামের পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, সর্বনিু ১০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ১২ দশমিক ২ শতাংশ সপ্তাহে অন্তত একবেলা না খেয়ে থাকে। এছাড়া ৯ শতাংশ মানুষ মাসে অন্তত একদিন না খেয়ে থেকেছে। নিু-আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার বেড়েছে। তবে ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ স্মার্ট ফোন ব্যবহার হয় গেম বা বিনোদন কাজে। দেশে পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ পায় যারা গরিব নয়। এছাড়া যারা গরিব নয় তবে যে কোনো সময় গরিব হতে পারে- এমন ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ সরকারি বিভিন্ন ভাতা পান। এই দুটো মিলে ধরলে দেখা যায়, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে ৪৪ দশমিক ৩০ শতাংশই সঠিক মানুষ পাচ্ছে না। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে গড়ে ২৭ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে। পরিবারগুলোয় সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মানুষের প্রত্যাশা হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন। এছাড়া রাজনৈতিক প্রত্যাশা হলো- দুর্নীতি দমন, সুশাসন এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের এখন তিন ধরনের সংকটের প্রভাব চলমান আছে। এগুলো হলো- কোভিড (২০২০-২০২২), মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।
সমীক্ষায় একটি পরিবার কোন খাতে কত খরচ করে, এর একটি চিত্র দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি পরিবারের মাসের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবার কেনায়। খাবার কিনতে মাসে গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা খরচ করে। এছাড়া প্রতিমাসে শিক্ষায় ১ হাজার ৮২২, চিকিৎসায় ১ হাজার ৫৫৬ টাকা, যাতায়াতে ১ হাজার ৪৭৮ টাকা এবং আবাসনে ১ হাজার ৮৯ টাকা খরচ হয়।
অনুষ্ঠানে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সংগত কারণে ক্ষুদ্র অর্থনীতির তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। অর্থনীতির পরিকল্পনায় জনমুখী দৃষ্টি (পিপলস লেন্স) থাকা খুবই জরুরি হয়ে গেছে। শুধু জিডিপির ওপর আলোচনা সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদের সমতা, ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা ও নাগরিকের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় পাঁচটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার।
এগুলো হলো- আমাদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী রোগের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। ক্রনিক রোগ মোকাবিলার জন্য একটি নতুন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রয়োজন। এছাড়া নারীপ্রধান পরিবারগুলো সমাজের সবচেয়ে নিচের স্তরে পড়ে আছে, তাই তাদের বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বাড়ছে, যা একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা- এটি এখনো ব্যাপক আকারে হয়নি, তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং যা উদ্বেগজনক। স্যানিটেশন সংকট উত্তরণ করে এসডিজি অর্জনের জন্য আমাদের হাতে মাত্র পাঁচ বছর আছে; কিন্তু এখনো প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ নন-স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করছে। ফলে নিরাপদ স্যানিটেশন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কর্মসংস্থান নিয়ে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আমাদের মাঝে এখন কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বেকারত্বের দুর্যোগের বাস্তবতার মধ্যে আমরা অবস্থান করছি। কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের ভাবনা এবং জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ বিষয়ে এখনই আমাদের আলোচনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের চাপ নিচের ৪০ শতাংশ পরিবারের ঋণ তাদের সঞ্চয়ের অন্তত দ্বিগুণ, এদিকে কর্মরত হিসাবে গণনা করা লোকজনের মধ্যে ৩৮ শতাংশ আসলে আংশিক বেকার (সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করছেন)। নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ ২৬ শতাংশে স্থবির। প্রায় অর্ধেক কর্মী স্বনিয়োজিত, যা যেমন টিকে থাকার কৌশল, তেমনই অনিশ্চয়তার প্রতীক। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রবাসী আয় ১৫ শতাংশ পরিবার মাসে গড়ে প্রায় ২৯ হাজার টাকা পাচ্ছে, যদিও তা মূলত উচ্চ আয়ের পরিবারে কেন্দ্রীভূত। আরও বলা হয়েছে, দেশীয় ভোক্তা বাজার অনেক বড়, যার আনুমানিক আকার ২১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সমীক্ষায় দেখা যায়, সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর ৬২ শতাংশ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হলেও সবচেয়ে দরিদ্র এক-তৃতীয়াংশ পরিবার সরাসরি নৈরাশ্য প্রকাশ করেছে। তবুও সামগ্রিকভাবে অর্ধেকেরও বেশি ৫৪ শতাংশ মানুষ সতর্ক আশাবাদী। পরিবারগুলো মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে ধনী-গরিব নির্বিশেষে তাদের আকাক্সক্ষা হলো একই শিক্ষা, নিরাপদ কর্মসংস্থান, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ।
পিপিআরসি মনে করে, জরুরি ভিত্তিতে নিুলিখিত পদক্ষেপের নেওয়া দরকার। যেমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের জন্য ইমার্জেন্সি ফ্যামিলি অ্যাসিস্ট্যান্স প্যাকেজ ঘোষণা, শিশু ও যুবদের জন্য এডুকেশন কন্টিনিউটি গ্রান্টস চালু; চাল, ডাল, তেল ও গ্যাসের মতো নিত্যপণ্যের উন্মুক্ত বাজার বিক্রয় সম্প্রসারণ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা পরিবারগুলোর জন্য আলাদা নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা। দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ হলো- হাউজহোল্ড রেজিলিয়েন্স টাস্কফোর্স গঠন, হাউজহোল্ড ইকোনমিক মনিটরিং সেল প্রতিষ্ঠা, অঞ্চলভিত্তিক সম্পদ বণ্টনে অধিক সমতা আনা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় মানুষের জীবন, কণ্ঠ ও ন্যায্যতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
তথ্য সূত্র : যুগান্তর,,,,
Post Comment