দীর্ঘ বিরতির পর নদীপথে ফিরল শতবর্ষী স্টিমার ‘মাহসুদ’
নিজস্ব প্রতিবেদক :
বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীরে ভোরের নরম আলো। নদীর বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুয়াশা, তার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে ওঠা সূর্যের রুপালি আভা, সব মিলিয়ে এক অন্যরকম সকাল। এমন ভোরে দূর থেকে ভেসে এলো প্যাডেল স্টিমারের বাঁশির মৃদু সুর, মনে হয় যেন সময় বহু বছর পেছনে ফিরে গেছে। কবি জীবনানন্দ দাশ হয়তো এমনই কোনো সকালের আলো ও হাওয়ায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন নদীর নীরব সৌন্দর্য।
দীর্ঘ বিরতির পর শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) সকালেই আবারও চালু হয়েছে বিআইডব্লিউটিসির ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার পিএস মাহসুদ। শতবর্ষী এই স্টিমার শুধু নৌযান নয়—এ দেশের নদীপথ, দক্ষিণাঞ্চলের জীবনযাত্রা এবং জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিতে ভরপুর একটি জীবন্ত ইতিহাস। নতুন প্রজন্মের জন্য এটি যেন নদীর বুকে ভাসমান এক সময়-সাক্ষী।
জীবনানন্দ দাশের জীবনে নদীপথ ছিল নীরব সঙ্গী।
১৯১৭ থেকে ১৯৩৫ এই সময়টায় পড়াশোনা, চাকরি ও পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি নিয়মিত স্টিমারে বরিশাল-খুলনা-কলকাতা রুটে যাতায়াত করতেন। তখন ট্রেনে বরিশাল যাওয়ার সুযোগ ছিল না; নদীই ছিল একমাত্র পথ। জীবনানন্দ গবেষক হেনরী স্বপন জানান, সেই সময়ের পিএস মাহসুদ, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্ন—এসব স্টিমারে কবি নিয়মিত ভ্রমণ করতেন। তার লেখায় বারবার ফিরে এসেছে স্টিমারের আলো-অন্ধকার, রাতের নিঃশব্দ হাওয়া, চাকার শব্দ ও নদীর আবহ।
অর্থনৈতিক টানাপড়েনে কবির প্রায় সব ভ্রমণই হতো থার্ড ক্লাসে। কাঠের বেঞ্চ, ভিড়, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ—এসব অভিজ্ঞতা আজকের প্রজন্মের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু সেই বাস্তবতা কবির কবিতা ও গদ্যের গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। নদীর নরম অন্ধকার, স্টিমারের বাঁশির টান—এসব তাঁর সাহিত্যকে দিয়েছে এক বিশেষ আবহ।
আঠারো শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে প্রথম প্যাডেল স্টিমার চালু করে।
নৌযানের দুই পাশে বিশাল চাকা থাকায় একে চলাচলে ‘রকেট’ বলা হতো। পরে নকশা বদলে চাকা পেছনে নেওয়া হয়। শেষ তিনটি প্যাডেল স্টিমারের চলাচল ২০২২ সালে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়। এক ঈদে বিশেষ ভ্রমণের পর আর চালু হয়নি। মনে হচ্ছিল, এ যুগে এগুলো আর নদীতে ফিরবে না। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা ও ইতিহাসের টান শেষ পর্যন্ত এগুলোকে ফের আলোয় এনেছে। পিএস মাহসুদ সংস্কার করে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে—ইঞ্জিন বদলানো, কাঠের ডেক ঠিক করা, চাকা রং করা। তবু স্টিমারের পুরোনো গন্ধ, বাঁশির সুর, কাঠের সিঁড়ির শব্দ—এসব আগের মতোই রাখা হয়েছে। প্রকৌশলীদের মতে, স্টিমারে পা রাখলেই মনে হবে যেন এক সময়-যন্ত্রে চড়ে অন্য যুগে ফিরে যাওয়া।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় শতবর্ষী স্টিমার পিএস মাহসুদের ভাড়া নির্ধারণ করেছে—সুলভ শ্রেণি: ৬০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি: ১,৬৫০ টাকা, প্রথম শ্রেণি: ২,৬০০ টাকা (ভ্যাটসহ)। ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশালের পথে স্টিমারটি শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় যাত্রা শুরু করবে। বরিশালে স্থায়ী ঘাট না থাকায় আপাতত ত্রিশ গোডাউন পন্টুনে ভেড়ানো হবে। শনিবার (২৯ নভেম্বর) সকালে আবার ঢাকার পথে রওনা দেবে। গত সপ্তাহে ভাড়া চূড়ান্ত না হওয়ায় প্রথম যাত্রা বাতিল হয়েছিল। এখনো আনুষ্ঠানিক অনুমতি ও ফিটনেস সনদ মেলেনি, তবু আজ শুক্রবার থেকেই স্টিমারটি চলাচল শুরু করেছে।
১৯২২ সালে নির্মিত পিএস মাহসুদ শত বছর ধরে নদীপথের ইতিহাস বহন করে আসছে। কিন্তু এর আসল আকর্ষণ বিলাসিতা নয়—তার আত্মা লুকিয়ে আছে স্মৃতিতে। কাঠের ডেকে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকালে মনে হয়, এখান দিয়েই হয়তো হেঁটে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ; চাঁদের আলো পড়েছিল ঢেউয়ের ভাঁজে, আর নদী নীরবে গল্প বলেছিল তাকে। এই স্টিমার তাই শুধু যাত্রা নয়—নদীর ওপর বয়ে যাওয়া এক অতীতের স্পর্শ।



Post Comment