দীর্ঘ ২২ বছর চাকুরী করেও স্থায়ী হয়নি বিসিসির ৬৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী
নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
বরিশাল সিটি করপোরেশনে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে জনগণকে সেবা দিয়ে আসলেও আজও স্থায়ীকরণ পাননি ৬৩ জন কর্মচারী। নিয়মিত বেতন, ইনক্রিমেন্ট, কর্মঘণ্টা সবই সিটি করপোরেশনের স্থায়ী কর্মচারীদের মতো হলেও তাদের পদ এখনো ‘অস্থায়ী’। দীর্ঘদিনের আশ্বাস, সভা-সেমিনারের প্রতিশ্রুতি, নথি ঘুরপাক সব কিছুর পরও স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত না হওয়ায় গভীর হতাশা আর ক্ষোভে আন্দোলনে নেমেছেন তারা। জানা গেছে, গত ৬ আগস্ট করপোরেশনের এক সাধারণ সভায় সাবেক প্রশাসক রায়হান কাওছার ৬৩ কর্মচারীকে স্থায়ীকরণের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব ছাড়ার আগ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেননি। আন্দোলনরত কর্মচারীদের অভিযোগ নবাগত প্রশাসকও একই কৌশলে কালক্ষেপণ করছেন। সূত্র জানায়, ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে প্রথম নির্বাচিত মেয়র অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান সরোয়ার বিভিন্ন পদে ১২১ জনকে নিয়োগ দেন। পরে এক-এগারোর সময় ভিন্ন ভিন্ন স্মারকে সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১০ সালে হাইকোর্ট এই কর্মচারীদের স্ব-স্ব পদে পুনর্বহালের আদেশ দেন। কিন্তু তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরন তাদের যোগদান করতে দেননি। ২০১৩ সালে আহসান হাবীব কামাল মেয়র নির্বাচিত হলে তাদের পুনরায় যোগদান সম্পন্ন হয়। বর্তমানে ওই ১২১ জনের মধ্যে ৬৩ জন করপোরেশনের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত রয়েছেন।
সিটি করপোরেশন চাকুরি বিধিমালা-২০১০ অনুসারে, এই কর্মচারীদের স্থায়ীকরণে কোনো আইনি বাধা নেই। বিধিমালার ৫৭(১) ধারার ক্রান্তিকালীন বিশেষ বিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ২০১০ সালের বিধিমালা কার্যকর হওয়ার পূর্বে সরকারি বিধি মোতাবেক যারা অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন এবং করপোরেশনে কর্মরত আছেন, তারা বিধিমালা অনুযায়ী করপোরেশনের চাকুরীতে ‘নিয়মিত’ হিসেবে গণ্য হবেন। অর্থাৎ ২০১০ সালের পূর্বে নিয়োগপ্রাপ্ত এই ৬৩ কর্মচারীকে স্থায়ী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি বরং বছরের পর বছর ধরে চলছে ‘নথি ঘোরা’র গল্প। যদিও তারা জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন পাচ্ছেন এবং বাৎসরিক ইনক্রিমেন্টও পাচ্ছেন। কিন্তু স্থায়ী না হওয়ায় তারা প্রতি ১০ বছরে গ্রেড পরিবর্তনের সুযোগ পাচ্ছেন না। এমনকি অবসরকালীন সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবেন তারা।
দীর্ঘ ২২ থেকে ২৫ বছর বরিশাল সিটি করপোরেশনে নিরলসভাবে জনগণকে সেবা দিয়ে আসার পরও নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে অন্দোলনে নামতে হচ্ছে এমন পরিস্থিতিকে নগরবাসী চরম অমানবিক ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। একাধিক নগরবাসী ক্ষোভ নিয়ে জানান, এই কর্মচারীরা জীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম সময়টুকু বরিশালের উন্নয়ন ও জনসেবায় ব্যয় করেছেন। এখন তাদের স্থায়ী না করা আইন-সম্মত নয়। তাদেরও পরিবার আছে, সন্তান আছে। তাদের প্রাপ্য অধিকার ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য দ্রুত স্থায়ী করার আহবান জানিয়েছেন তারা।
এদিকে আন্দোলনরত কর্মচারীরা জানান, দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে স্থায়ীকরণের নথিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্বাক্ষর দিয়েছেন। এখন শুধু বাকি আছেন প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান। তারা আশা করছেন তিনি আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে দ্রুত নথিতে স্বাক্ষর করবেন। তবে নথিতে স্বাক্ষর না হলে পুনরায় আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়ে তারা বলেন, “আমাদের স্থায়ীকরণ নিশ্চিত করা হলে আন্দোলন স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধ্য হবো।”
এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বলেন, “৬৩ জন কর্মচারীর স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আইনি কাঠামোর মধ্যে সম্পন্ন করার বিষয়। আমরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও দায়িত্ব নিয়ে যাচাই-বাছাই করেছি। আমাদের লক্ষ্য হলো আইন, বিধি-বিধান এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া মেনে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করা। আশা করি খুব শিগগিরই বিষয়টির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে এবং সকল পক্ষের সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যাবে। এ প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ যাতে বিভ্রান্ত বা উদ্বিগ্ন না হন, সে বিষয়েও আমরা সচেষ্ট আছি।” তবে এ বিষয়ে আক্ষেপ জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), বরিশাল মহানগর সেক্রেটারি রফিকুল আলম। তিনি বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৬৩ জন কর্মচারীর স্থায়ীকরণ ইস্যু আজ শুধু প্রশাসনিক জটিলতা নয় এটি মানবিকতার প্রশ্ন। কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। আইন স্পষ্ট, নথিতে স্বাক্ষরও প্রস্তুত এখন প্রয়োজন কেবল একটি সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তই ৬৩টি পরিবারে নিরাপত্তা এনে দিতে পারে এবং বরিশাল সিটি প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা আরও দৃঢ় করতে পারে। এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, “৬৩ জন কর্মচারীর স্থায়ীকরণ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে সঠিক ও দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে আমি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। আলোচনার পূর্বে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত জানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়”। চাকুরি বিধিমালা ২০১০ অনুযায়ী তাদের স্থায়ীকরণে বাধা নেই এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বিধিমালা গভীরভাবে পর্যালোচনা না করে এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আমরা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে খুব শীঘ্রই একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবো, ইনশল্লাহ।”



Post Comment