নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর নানা হিসাব-নিকাশ জোট গঠনে পর্দার আড়ালে তৎপরতা
অনলাইন ডেক্স ।।
আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে নতুন পথে রাজনীতি। নানা ইস্যুতে কয়েকটি দল আন্দোলন নিয়ে রাজপথে থাকলেও ভেতরে ভেতরে তারাও নির্বাচনমুখী। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে ভোটের হিসাব-নিকাশও। নির্বাচনি জোট গঠনেও পর্দার আড়ালে চলছে নানা আলোচনা ও তৎপরতা। কোন দল কোন জোটে যাবে, তা নিয়েও জনমনে কৌতূহল রয়েছে। তবে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আলাদা পথেই হাঁটছে। দল দুটি পৃথক জোট গঠনে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিরও জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বামপন্থি দলগুলোর একটি জোট এবং কয়েকটি ইসলামি দল মিলে আরেকটি জোট গঠনের গুঞ্জন রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট ও সমঝোতার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। নির্বাচন এলেই এমন ঘটনা আগেও দেখা গেছে। তবে এবার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হওয়ায় এখন দৃশ্যপটে নেই আওয়ামী লীগ। তাই ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি এখন দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জায়গায় রয়েছে। আবার অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে আছে এক সময়ের বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের অংশীদার ও মিত্রদল জামায়াতে ইসলামীও। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট গঠন অথবা সমঝোতাসহ নানা কৌশল গ্রহণের পরিকল্পনা সঠিকভাবে না নিতে পারলে নেতৃত্বে থাকা দল প্রত্যাশিত ফলাফল নাও পেতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসাবে নিউইয়র্কে যাচ্ছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ চার নেতা। নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের এ সফর নানা ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা তারা দেশে ফিরলে কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হবে। সার্বিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে দলগুলোর মধ্যে যেসব ইস্যু নিয়ে এখন মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে, তা দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে-এমন প্রত্যাশা সবার।
জোট গঠন নিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্তত বিশটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে যুগান্তরের। আলাপকালে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার কোনো দলের এককভাবে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা হয় জোট, না হয় আসন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেওয়ার পক্ষে। দলগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত যেটুকু তৎপরতা তা থেকে জানা যায়, সমমনা দল ও জোট নিয়ে বিএনপি একটি বড় জোট করতে পারে। পাশাপাশি কয়েকটি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতাও হতে পারে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামি দলগুলোর পৃথক জোট বা আসন সমঝোতা হতে পারে। পাশাপাশি এনসিপিরও জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে উদারপন্থি বলে পরিচিত কয়েকটি দলকে নিয়ে। এছাড়া বাম ও ইসলামি দলগুলোর আরও দুটি পৃথক জোট গঠনের তৎপরতা আছে। তবে এখন যা-ই করা হোক না কেন নির্বাচনের তফশিলের পর আনুষ্ঠানিকভাবে জোট কিংবা সমঝোতার বিষয়টি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘রাজনীতির মেরুকরণ আর কী হবে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি-এই তিন দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। আবার এর মধ্যে দুদল একসঙ্গে ফ্রন্ট করতে পারে। আর তারেক রহমান (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তো আগেই বলেছেন জনগণের ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত সব দলকে নিয়ে সরকার গঠন করবেন।’
এদিকে এবারের নির্বাচন সহজ নয়-এমনটা ধরে বিএনপিও নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা হিসাব-নিকাশ করছে। বিএনপি কোন ফরম্যাটে বা কাঠামোতে জোট করবে, তা নিয়ে এখন বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। তবে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোকে সঙ্গে নিয়েই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে-দলগুলোর মধ্যে এমন আলোচনা আছে। জানা গেছে, জোট গঠনে অনেকটাই নির্ভার দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দলটি এবার ডান-বাম ও ইসলামি দলগুলোকে একসঙ্গে নিতে চায়। দলগুলো হলো-লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ১১টি দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামি দলও বিএনপির সঙ্গে জোটে যুক্ত হতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি দল অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামেও যুক্ত। এছাড়াও এনসিপি নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের শিডিউল যখন ঘোষণা হবে, তখন আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করব। যদি জোটের প্রয়োজন হয়, তাহলে জোট হবে। এখন সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দলগুলো নিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলন যুগপৎভাবে করেছি। কিন্তু জোট গঠনের বিষয়ে এখনো কোনো ঘোষণা দিইনি।’
অন্যদিকে জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলোও বসে নেই। জামায়াত জোট কিংবা আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেবে-এটা অনেকটা নিশ্চিত। ইতোমধ্যে জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনসহ নানা দাবিতে জামায়াতসহ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাগপা অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করছে। তবে জামায়াত কাদের সঙ্গে জোট করছে তা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে বা পরে স্পষ্ট হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ‘ইসলামপন্থি দলগুলো যাতে এক জায়গায় থাকতে পারে সেই চেষ্টা করছি। আলাপ-আলোচনা চলছে।’
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি আসনে ইসলামপন্থিদের একক প্রার্থী দেওয়ার আলোচনা চলছে। সবাই পজিটিভ। সেটা নির্বাচনি আসন সমঝোতাও হতে পারে।’
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এনসিপিও শেষ পর্যন্ত জোট গঠন করতে পারে। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গেও আসন সমঝোতাও হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। জানা গেছে, এনসিপি জোট গঠন করলে তাতে এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি দলকে দেখা যেতে পারে।
তবে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জোট নিয়ে দলে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এনসিপি এখনো কোনো জোট অথবা সমঝোতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। কারও সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও হয়নি। একই ধরনের মন্তব্য করেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান।
এদিকে নির্বাচনের আগে বাম ধারার সব দল ও সংগঠনকে নিয়ে একটি জোট গঠনে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এই জোটে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ছয় দল-বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ থাকছে। এর বাইরে আদিবাসী সংগঠন, দলিত সংগঠন এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বদল চাই। বিগত সময়ে শাসক দলগুলোকে আমরা দেখেছি। তাই বিকল্প জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।’ এছাড়াও ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল আরও একটি জোট করার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের মতে, শেষ পর্যন্ত ইসলামপন্থিরা এক লাইনে চলে আসতে পারে। অথবা বিরোধী দল হওয়ার জন্য ইসলামপন্থিরা এক ধারায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নির্বাচনের আগে। আবার যারা বৈষম্যবিরোধী আছে তাদের থেকে যেসব দল বের হচ্ছে তাদের মধ্যেও একটা ঐক্য হতে পারে। বাম ঘরানার অথবা সেক্যুলার ঘরানার-তাদের মধ্যেও একটা ঐক্য তৈরি হতে পারে। তবে এ অবস্থায় বিএনপির বিপরীতে বিকল্প কোনো শক্তি বা ধারা তৈরি হতে আরও সময় লাগবে।
তথ্য সূত্র : যুগান্তর,,,,
Post Comment