পেঁয়াজের বাজারে আগুন, নিত্যপণ্যের-ঊর্ধ্বগতিতে অস্থির বরিশালের মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে বরিশালের পেঁয়াজের বাজার। গত ৩-৪ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে অন্তত ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত। সরবরাহ না বাড়লে সামনে দাম আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে মুনাফা লুটার পাঁয়তারা করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে বরিশালের কয়েকটি বাজার ও আড়ত ঘুরে দেখা যায়, গত শুক্র-শনিবার যেখানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০/ ১০০ টাকায়, সেখানে আজ বুধবার (৫ নভেম্বর) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় মানভেদে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, দাম কেন বাড়ছে, তার সুনির্দিষ্ট কারণ তাদের জানা নেই। পেঁয়াজ বিক্রেতা আলআমিন বলেন, ‘পাইকারিতে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে দাম। কেন বেড়েছে বুঝতেছি না। পাইকারিতে বাড়ায় খুচরা পর্যায়েও বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘দাম বাড়ার পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোনো হাত নেই। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, সেই অনুযায়ী বিক্রি করি। আমরা নিজেরাও জানি না কেন এমন বাড়ল। হঠাৎ দাম বাড়ায় কমেছে বেচাকেনাও।’
এদিকে শুধু পেঁয়াজ নয় ডাল, ভোজ্যতেল, সবজি সহ নানা নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে বরিশালের সাধারণ মানুষের সংসার যেন আর চলছেই না। মাসের বাজেট এখন ফুরিয়ে যাচ্ছে ২০ দিনের মধ্যেই। সর্বত্রই নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি চরম অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের হতাশা ক্রমশ ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে।
খাদ্য বিভাগ থেকে প্রতিদিন ৩০ টাকা কেজি দরে ৫৬ টন চাল ও ২৪ টাকা দরে ৯২ টন আটা বিক্রির পরেও গত মাসে চালের বাজারে ঊর্ধ্বগতি আটকানো গেলেও আটার দাম ফের বাড়ছে। ফলে খাদ্যপণ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই।
এবারের পুরো বর্ষা মৌসুম জুড়েই স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টিপাত সবজির বাগানকে বারবারই বিপর্যস্ত করায় বাজারে এর বিরূপ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। গত মাসেই বরিশালে স্বাভাবিকের ৪৭২% বেশি বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, যা একটি রেকর্ড। এমনকি স্বাভাবিক ১৭ দিনের স্থলে অক্টোবর মাসে বরিশালে ২৪ দিন বৃষ্টি ঝরেছে।
এই রেকর্ড বৃষ্টির ফলে বরিশালের সবজির বাজারে চরম বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আগাম শীতকালীন সবজির বেশিরভাগই নষ্ট হয়েছে। প্রায় ১৪ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল কৃষি অঞ্চলে বছরে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টন সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু গত মাসখানেক ধরে বরিশালের বাজারে ৮০ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজি মিলছে না। বাজারে আসা নতুন অপরিপক্ব কোনো কোনো সবজির কেজি ১২০ টাকা। ফলে একটি ছোট পরিবারের এখন ডাল-ভাত আর সবজি দিয়ে তিনবেলা খাবার জোগাড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দীর্ঘদিন পর বরিশালের বাজারে পেঁয়াজ আবার সেঞ্চুরি হাকিয়ে এখন ১৩০/১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বিগত রবি মৌসুমে দেশে প্রায় ৪২ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ায় বাজারে এর কোনো ঘাটতি নেই। পুরো বছর জুড়েই দেশি পেঁয়াজে চাহিদা মিটলেও কৃষকের কাছ থেকে ১৫ টাকা কেজিতে কেনা পেঁয়াজ এতদিন ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রির পর একলাফে তা দ্বিগুণেরও ওপরে উঠে গেছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই।
সবজির বাজারে আগুনের কারণে এতদিন সাধারণ মানুষ ২০ টাকা কেজির আলু দিয়ে চাহিদা মেটালেও গত এক সপ্তাহে সেখানেও দুঃসংবাদ। আলুর দামও একলাফে ২৫% বেড়ে এখন ২৫ টাকা কেজি। কিন্তু কী কারণে পেঁয়াজ ও আলুর দাম বাড়ল, তার কোনো জবাব নেই বরিশালের পাইকারি বাজারের আড়তদারদের কাছে। ‘বাজার মনিটরিং’ নামে প্রশাসনের কোনো তৎপরতাও নেই দীর্ঘদিন।
অপরদিকে খোলা বাজারে মসুর ডালের কেজি এখন ১৬০ টাকা। এতদিন গরুর খাবার হিসেবে বিবেচিত খেসারির ডালের কেজিও এখন ১২৫ টাকা। ডিমের হালি ৪৮ টাকায় ওঠার পর আর নামার কোনো লক্ষণ নেই। বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার এখন ১৯০ টাকা। ভারতীয় নিম্নমানের আদার কেজি ১৩০ টাকা, চীনা আদা ১৬০ টাকা কেজি। গরুর গোশতও পাউন্ডে ৮০০ টাকা ছুঁয়েছে।
ইলিশের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর বাজারে মাছের সরবরাহ বাড়লেও দাম এখনো কমেনি। তবে এ নিষেধাজ্ঞার পরে বাজারে নদীর পাঙ্গাসের আমদানি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে তা সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইলিশের কেজি এখনো সাইজভেদে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা কেজি।
এদিকে ওএমএস কর্মসূচির আওতায় প্রায় বছর জুড়েই বরিশাল খাদ্য অঞ্চলের সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা সদরগুলোতে প্রায় ১৩০ জন ডিলারের মাধ্যমে প্রতিদিন ৫৬ টন চাল ও ৯২ টন আটা বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে বরিশাল মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ৩০ জন ছাড়াও জেলা সদরে ৫ জন করে এবং ৩৬টি উপজেলা সদরে ৭২ জন ডিলার এসব চাল ও আটা বিক্রি করছেন।
গত অর্থবছরে এ অঞ্চলে ১০ হাজার ৩০৬ টন চাল ও প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার টন আটা যথাক্রমে ৩০ টাকা ও ২৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের গত ২০ অক্টোবর পর্যন্ত আরও প্রায় ৫ হাজার টন আটা ও ৪,২৪৭ টন চাল বিক্রি করা হয়েছে বলে খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
তবে চালের বাজারে গত মাসে কিছুটা নিম্নমুখী প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও গত সপ্তাহে আটার দাম আবার বেড়েছে। বরিশালের বাজারে এখন খোলা আটা ৫০ টাকা এবং এক কেজির প্যাকেট আটা ৬৫ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। বুধবার বরিশাল মহানগরীসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য কিছু বাজারে খোঁজ নিয়ে ক্রেতাদের নিঃশ্বাসের খবরই মিলেছে। নারী-পুরুষ অনেক ক্রেতাই হতাশার সঙ্গে ক্ষোভের কথাও বলেছেন।



Post Comment