Loading Now

বরিশালে মোটরবাইকে হলার ও হাইড্রোলিক হর্নে অতিষ্ঠ মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

বরিশালে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মোটরবাইক চালকদের মাঝে বেড়েছে উচ্চ শব্দের হলার (একজস্ট/সাইলেন্সার) ব্যবহারের প্রবনতা। নগরীর প্রতিটি স্থান থেকে উচ্চ গতিতে হলার থেকে নির্গত কান ফাটানো শব্দ করে দিনে-রাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এরা। এর সাথে রয়েছে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের প্রবনতা। এসব মোটরসাইকেল চালকদের প্রায় সবাই নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর মোটরসাইকেল বা মোটরযান চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার কথা থাকলেও বরিশালের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। মটর সাইকেল কেনার পর শোরুম থেকে তাদর লাইসেন্স এর ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। অনেক সময় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিআরটিএ থেকে দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স করিয়ে থাকে, অনেকের আবার লাইসেন্স নেই। যার ফলে অলিগলিতে ১৪ থেকে ১৭ বছরের তরুণরা মোটরসাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অহরহ। শুধু তাই নয় উচ্চশব্দের হলার (এগজস্ট/সাইলেন্সার) ব্যবহার করে তৈরি করছে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণ।

বিশেষ করে সদর রোডের আশপাশের এলাকা, নতুন বাজার, বাংলা বাজার, বান্দ রোড, সাগরদী, সিএন্ডবি রোড, কাশিপুর সহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকার সড়কগুলোসহ গোটা বরিশালে উচ্চশব্দের হলার লাগিয়ে তারা নগরবাসীর মধ্যে তৈরি করেছে আতঙ্ক।

তাদের বাধা দিতে গেলে কেউ কেউ হচ্ছেন হামলার শিকারও। মূল সড়কে নিয়ম ভেঙে মোটরসাইকেল চালালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানা ধরনের জরিমানা ও বাইক আটক করলেও আবাসিক এলাকায় দাপিয়ে বেড়ানো এসব চালকদের যেন দেখার কেউ নেই। দিন দিন তাদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। এমনকি রাস্তা আটকিয়ে তারা রেস পর্যন্ত খেলছেন।

বরিশালের কয়েকটি এলাকায় দেখা যায়, এসব মোটরসাইকেল চালকদের প্রায় সবাই নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। পূর্বে নগরীতে এমন মোডিফায়েড বাইকের সংখ্যা হাতেগোনা থাকলেও এখন সেই সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২ থেকে প্রায় ৬ লাখ টাকা দামের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বাইকগুলোকে মোডিফাই করে পরিণত করা হচ্ছে এমন অস্বস্তিকর যানবাহনে। যার বেপরোয়া চলাচলে সৃষ্ট উচ্চশব্দে এক রকম অতিষ্ঠ নগরীর পথচারীসহ অন্যান্য যান চালকরা।
শুধুমাত্র নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা আর শখের বশে দামী মোটরবাইকের ক্ষতি করে উচ্চশব্দের বাইকে রূপান্তর করার কথা স্বীকার করেছে একাধিক কিশোর। এজন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করছে।

অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবে শব্দ দূষণের ভয়ঙ্কর মাত্রায় থাকা নগরীতে বাইকগুলো এখন চরম বিরক্তির যানবাহন, যা বাড়াচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। ট্রাফিক আইন অনুযায়ী এটি দন্ডনীয় অপরাধ। তাই এদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগের দাবি সচেতন মহলের। এসব যানবাহন ব্যবহারকারীর বেশিরভাগই কিশোর।

হাইড্রোলিক হর্নের মাত্রাতিরিক্ত শব্দে বিরক্ত হয়ে পথচারীরা প্রতিবাদ করলে তাদের প্রকাশ্যে অপমান করা হয়। যার কারনে অনেকই নিরবতা পালন করেন।

এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, এই হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু নির্দেশনার পরও যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ হয়নি। এখনো উচ্চ শব্দের হর্ন বাজিয়ে ছুটছে যানবাহন। হর্ন বাজানোর ক্ষেত্রেও মানা হচ্ছে না এলাকাভিত্তিক নির্দেশিকা। এছাড়া হাইকোর্টের রায়ে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি ও বিক্রি বন্ধের নির্দেশ থাকলেও তা বন্ধ হয়নি। বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানগুলোতে হরদম এ ধরনের নিষিদ্ধ হর্ন বিক্রি হচ্ছে। যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নের শব্দে একদিকে যেমন মানুষজন অতিষ্ঠ, তেমনি এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাংলা বাজার এলাকার ফারদিন নামের এক কিশোর বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করায় তাকে পরিবার থেকে বাইক কিনে দেওয়া হয়েছে। নিজের বাইকটিকে স্বতন্ত্র বানাতে মূলত হলারটি লাগিয়েছেন। নগরীর প্রায় সব মোটর মেকানিক এই মোডিফাই করতে পারে। সে হলার লাগিয়েছে তবে অনেকেই উচ্চশব্দের মোডিফিকেশনের জন্য নিজেদের বাইকের সাইলেন্সার পাইপটি কেটেও ফেলে। শুধু ট্রাফিক পুলিশের চোখ এড়িয়ে চলতে হয়।

সন্ধ্যার পর থেকে এসব হর্নের কারণে বাসায় থাকা দায় উল্লেখ করে রাজাবাহাদুর সড়ক এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় এসব হাইড্রোলিক হর্নওয়ালা বাইকারদের অত্যাচার। আমার ২ বছরের বাচ্চা ভয়ে কান্না করে ওঠে। কাকে এটি নিয়ে অভিযোগ করব, কি অভিযোগ করব কিছুই বুঝতে পারি না।

বটতলা এলাকার বাসিন্দা নারগিস বেগম বলেন, ক’দিন থেকেই কানের সমস্যায় ভুগছেন। বাম কানে গাড়ির হর্নের কোনো শব্দ শুনতে পারছেন না। গিয়েছিলাম নাক, কান, গলা ডাক্তার দেখাতে। কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার পর চিকিৎসক জানিয়েছেন প্রতিদিন মাত্রাতিরিক্ত শব্দগ্রহণের কারণে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল তবে আপাতত হেয়ারিং এইড মেশিন ব্যবহার করলে শুনতে পারবেন। তারপর থেকেই হেয়ারিং এইড মেশিনই ব্যবহার করছেন তিনি।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দদূষণের ফলে বরিশালে এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ দূষণের প্রধান উৎস বিভিন্ন যানবাহনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্ন। যা শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ ব্যক্তিসহ বসবাসযোগ্য নগরী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। অতিসত্বর এসব যানবাহনের শব্দদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে একটি বধির প্রজন্ম বেড়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।

শব্দ দূষণ বিষয়ে শেবাচিম হাসপাতালের নাক, কান, গলা রোগের একাধিক চিকিৎসকদের সাথে কথা বলতে গেলে তারা জানান, শব্দ দূষণ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ শ্রবণ পরিবেশ তৈরির জন্য শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি বলবৎ করতে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে প্রচার চালাতে হবে। শব্দ দূষণ প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে তারা বলেন, শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিগুলো যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলোর এখতিয়ার নির্ধারণ এবং সারা দেশে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র এবং ইশারা ভাষা শিক্ষণ সহজলভ্য করা। বিশেষ করে এসব হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে।

একজন মানুষ যদি টানা ৮ ঘণ্টা ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ প্রতিদিন শোনে তাহলে ২৫ বছরের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বধির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে তারা আরও বলেন, শব্দদূষণ চোখ ও মাথার বিভিন্ন সমস্যার জন্যও দায়ী। শহরের বেশিরভাগ মানুষই মাথার যন্ত্রণায় ভোগে, যার অন্যতম কারণ শব্দদূষণ। এছাড়া ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে মানুষ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক এমনকি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য নিজের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে শব্দ দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের দায়ীত্বশীল সূত্র জানায়, সড়কে সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ট্রাফিক বিভাগ সর্বদা সচেতন রয়েছে। এই ধরনের বাইকের হলার, উচ্চ শব্দের হর্ন লাগানো বেশ গুরুতর একটি অপরাধ। ধরা পড়লেই এদের জরিমানা করা হয়। এমন বাইকারদের নিয়ন্ত্রনে আনতে আরও কঠোর হবে ট্রাফিক বিভাগ। এ সংক্রান্ত নির্ধারিত আইনের ধারা-৮৮ মোতাবেক নির্ধারিত শব্দমাত্রার অতিরিক্ত উচ্চমাত্রার কোনরূপ শব্দ সৃষ্টি বা হর্ন বাজানো বা কোন যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা হর্ন মোটরযানের স্থাপন সংক্রান্ত ৪৫ এর বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা সহ অনধিক ১ বছর দন্ড দেয়া যেতে পারে।

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED