বরিশাল বেতারে নাট্যশিল্পী তালিকাভুক্তিতে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
বাংলাদেশ বেতার বরিশালে নাট্যশিল্পী তালিকাভুক্তি কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। আবেদন না করেও উত্তীর্ণ হওয়া, বেতারের স্টাফ, কর্মকর্তার স্ত্রীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সমালোচনার মুখে তৃতীয় দফায় নতুন তালিকা প্রকাশ করে নিজেদের দোষ ঢাকতে চাইছে বেতার কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ বেতার বরিশাল থেকে জানা গেছে, উপআঞ্চলিক পরিচালক শফিকুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক হাসনাইন ইমতিয়াজ সাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল নাট্যশিল্পী তালিকাভুক্তির অডিশনের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করেন। আবেদনের শেষ তারিখ নির্ধারিত হয় ১০ মে। নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত ১৩১ জনের আবেদন পায় বরিশাল বেতার। আবেদনপত্রগুলো যাচাই-বাছাই শেষে ১২ মে বিকেলে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে। একইসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, তালিকাক্রমের ১ থেকে ৮০ নম্বর পর্যন্ত আবেদনকারীর অডিশন ২৬ মে এবং ৮১ থেকে ১৩১ পর্যন্ত আবেদনকারীর অডিশন ২৭ মে অনুষ্ঠিত হবে।
দুই দিনের অডিশন শেষে ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় উত্তীর্ণদের তালিকা প্রকাশ করলে দেখা যায়, আবেদনের তালিকায় নাম না থাকলেও রীণা পারভীন ও অমিতা রায় নামে দুজন রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা আগে থেকেই বেতারে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত।
শুধু তারাই নন উত্তীর্ণ ৫৪ জনের মধ্যে ২৬ জনই বেতারে ঘোষক-ঘোষিকা ও কণ্ঠশিল্পী বিভাগে যুক্ত আছেন। এ ছাড়া উপআঞ্চলিক পরিচালক রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফারহানা ইসলাম লিনা, বেতারের কর্মচারী জাহানারা ইয়াসমিন উত্তীর্ণ হয়েছেন।
টেলিভিশন নাট্যশিল্পী অভিষেক চক্রবর্তী বলেন, এটি অত্যান্ত দুঃখজনক ব্যাপার। প্রকৃত নাট্যশিল্পীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক দুর্বল এবং সুপারিশপ্রাপ্তদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আমি নিজেও অডিশন দিয়েছি। অডিশনে আমি দক্ষ নই বলে মনে হয়েছে সেজন্য হয়তো আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু যারা বরিশাশের নাট্য অঙ্গনে নিয়মিত চর্চা করছেন, যাদের মাধ্যমে অসংখ্য নাট্যকর্মী তৈরি হচ্ছেন, তারা অযোগ্য হলেন কীভাবে সেটা বোধগম্য নয়।
নাট্যশিল্পী আসাদুজ্জামান ডিউক বলেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি বরিশালে নাটক নিয়ে কাজ করছি। মঞ্চে অসংখ্য নাটকে কাজ করেছি। এখন টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটকে কাজ করছি। আমার আফসোস লাগে, যারা উচ্চারণ জানে না তারাও উত্তীর্ণ হলো, অথচ যোগ্যরা বাদ পড়লেন।
এই অভিনেতা বলেন, বিশেষ বিশেষ বিবেচনায় নাট্যকর্মী নেওয়া হয়েছে। এভাবে যদি তারা নেন তাহলে অডিশনের আয়োজন করলেন কেন? আমি মনে করি, অডিশনের আয়োজন করে সুপারিশ আর বিশেষ বিবেচনায় উত্তীর্ণ করে বরিশালের নাট্যকর্মীদের অপমান করেছেন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে যারা আবেদন করেনি, চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম নেই তারাও দেখছি উত্তীর্ণের তালিকায় আছেন। আমি মনে করি, পুনরায় অডিশনের আয়োজন করে পক্ষপাতহীনভাবে পুনরায় যাচাই-বাছাই করে নাট্যকর্মী তালিকাভুক্ত করা হোক।
নাট্যকর্মী মিম বলেন, বেতারে নাট্যকর্মী তালিকাভুক্তির পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ। অডিশনের নামে ধোকা দেওয়া হয়েছে। যোগ্যদের বাদ দিয়ে কর্মকর্তাদের স্ত্রী, স্টাফ, ঘোষক আর বিশেষ বিবেচনায় কয়েকজনকে নেওয়া হয়েছে। কয়েকজন শিশুকে নেওয়া হয়েছে এটি খুবই ভালো দিক। কিন্তু যে শিশুরা ভালো বাচনভঙ্গি আর আবৃত্তি পারে, নাটকে অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। অডিশনটি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে তখনই যখন দেখলাম আবেদন না করেও উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেই ত্রুটি আড়াল করতে উর্ত্তীণের তালিকা প্রকাশের এক দিন পরে আবারও আবেদনকারীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেছে। যেখানে আগে যারা আবেদন করেনি তাদের নাম সংযোজন করে আরও বির্তকের জন্ম দিয়েছে।
নাট্য নির্মাতা জসীম উদ্দিন ইমন বলেন, বেতারের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে অডিশনের নামে আইওয়াশ তৈরি করে আগে থেকে ঠিক করা লোকগুলোকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আমার নাটকের টিমের কয়েকজন অভিনেতা আবেদন করেছিলেন। এরমধ্যে একজন রয়েছেন অভিনয়ে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত। আবৃত্তি, কণ্ঠ অভিনয়ে পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু সে বাদ পড়ে গেলো। অথচ একজনকে দেখলাম তিনি উচ্চারণে ঘাটতি নিয়েও উত্তীর্ণ হয়েছেন। নাট্য অঙ্গনের মেধাবীদের বাদ দিয়ে বেতার কর্তৃপক্ষ তাদের পছন্দ মতো লোক তালিকাভুক্ত করেছেন। এভাবে চললে বরিশাল বেতার থেকে শিল্পীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে।
এসব বিষয়ে উপআঞ্চলিক পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার স্ত্রী বরিশাল বেতারে ২০০২ সালে ঘোষক হিসেবে তালিকাভুক্ত, ২০০৫ সালে আবৃত্তি এবং সংবাদ পাঠক হিসেবে তালিকাভুক্ত। আমাদের বিয়ে হয় ২০০৬ সালে। আমাদের বিয়ের আগেই তিনি বরিশাল বেতারে তালিকাভুক্ত। নাট্যশিল্পী হিসেবে তিনি আবেদন করায় বিচারকরা তার অডিশন নিয়েছেন। বেতারের সম্প্রচার নীতিমালা অনুসারে আগে তালিকাভুক্ত হলেও অডিশনে অংশগ্রহণে কোনো বাধা নাই। আর পোষ্যবলে অর্থাৎ কোনো কর্মকর্তার পরিবারের কেউ বেতারের কার্যক্রমে সংযুক্ত আছেন তা আমাদের ঢাকায় রিপোর্ট পাঠাতে হয়।
আবেদন না করেও নাট্যতালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়ে আঞ্চলিক পরিচালক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, আবেদনের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর আমরা কয়েকজনের আবেদন রেখেছি। অডিশনে এরমধ্যে দুজন উত্তীর্ণ হয়েছেন। যাদের আবেদন সময়সীমার পর নিয়েছি তারা আমার বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী।
আবেদনের সময় শেষের পরে আবেদন গ্রহণ করা কি অনিয়ম নয়, জানতে চাইলে বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ইতিবাচক দৃষ্টিতে অনিয়মটি করা হয়েছে। সুতরাং ওই অর্থে অনিয়ম বলা যায় না। এই কর্মকর্তা বলেন, স্বজনপ্রীতি, সুপারিশে কাউকে নেওয়া হয়নি। তবে আগে প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম ছিল না তাদের নাম সংযোজন করে দরকার হলে আমরা সংশোধিত একটি তালিকা প্রকাশ করে দেবো।
বুধবার (২৮ মে) দুপুরে আঞ্চলিক পরিচালকের এমন প্রতিশ্রুতির পর বিকেলে সময়সীমা শেষ হওয়ার পর গ্রহণ করা ১১ জনের নাম যুক্ত করে মোট ১৪২ জন আবেদনকারীর সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে বাংলাদেশ বেতার বরিশাল ফেসবুক পেজে।
Post Comment