Loading Now

বিতর্কের মাঝেই দায়িত্বে নিলেন ববি’র নতুন উপাচার্য

বিতর্কিত ড. আতিউরের ‘বই উন্মোচন’ অনুষ্ঠানেও ছিলেন অতিথি

♦মেহেদী হাসান ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিতর্কিত ও সমালোচিত গভর্নরের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই থাকতেন অতিথি, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বাদশ নির্বাচনের পক্ষে বিবৃতি, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক উপাচার্য’র যোগসাজসে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি নবনিযুক্ত উপাচার্য হিসেবে যোগদান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত পত্রাদি প্রেরণ করেন।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সরকারি সাধারণ বিশ^বিদ্যালয় শাখার উপসচিব মো. শাহীনুর ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বরিশাল বিশ^বিদ্যালয় আইন ২০০৬ এর ১০(১) ধারা অনুযায়ী অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদানের তারিখ থেকে আগামী ৪ বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত এই উপাচার্য’র বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম, রিজার্ভ চুরি, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারীতে নাম আসা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিতর্কিত ও সমালোচিত সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের রচিত ‘ফিরে দেখা” শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে সেই অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ঢাবি’র ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিতর্কিত ও সমালোচিত সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান নিয়োগ পাওয়ায় তাকে যে সংর্বধনা দেয়া হয়, সেখানেও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এই অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। ওই অনুষ্ঠানটি ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের মে মাসের ২ তারিখ বাংলাদেশ ব্যাংকের দশম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. আতিউর রহমান। তার মেয়াদকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক কেলেঙ্কারী, ডেসনিটি প্রতারণাসহ ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন অনিয়ম সংঘঠিত হয়। এমনিক বেসিক ব্যাংকের অর্থ লুটের ঘটনাও ঘটেছে তার মেয়াদামলে। বিগত বছরগুলোতে সেই আতিউর রহমানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন।
সূত্রে আরো জানায়, বিগত দিনে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের কলঙ্কজনক ডামি নির্বাচনকে সমর্থন জানিয়ে গত বছরের ২৩ নভেম্বর গণমাধ্যমে ৩৫০ বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিবৃতিতে আওয়ামী পন্থী অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে স্বাক্ষর করেছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন।
বিবৃতিতে অধ্যাপক ড. শরমিনসহ অন্যান্যরা বলেন, সংবিধানের বাইরে গিয়ে ‘সংকট’ সমাধানের যে কথা বলা হচ্ছে তা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই শক্তি সংবিধানকে পদদলিত করে গণতন্ত্র হত্যার মাধ্যমে ওয়ান ইলেভেনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় বলেও মন্তব্য করেন তারা। ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “বিরাজনীতিকীকরণের কৌশল হিসেবে এবার তারা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য মায়াকান্না শুরু করেছে। ‘ডক্ট্রিন’ অব নেসেসিটি’র কথা বলে সংবিধানের বাইরে গিয়ে ‘সংকট’ সমাধানের যে কথা তারা বলছেন, তা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে আমরা মনে করি। এরা সংবিধানকে পদদলিত করে গণতন্ত্র হত্যার মাধ্যমে ‘ওয়ান ইলেভেনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। কার্যত, বিবৃতিতে সংবিধান লংঘন করে সেটিকে ‘মার্জনা’ দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়- রাষ্ট্রদ্রোহিতারও শামিল। এ ধরনের অপচেষ্টা তারা অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালেও করেছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা ও অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর তথাকথিত ‘মার্জনা’ প্রদান করার মাধ্যমে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং সংবিধান লংঘনের মত ঘটনাগুলোকে যারা বৈধতা দিয়ে দেশকে খুনীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল, তাদেরই মিত্ররা বিভিন্ন সময়ে ঘোলাজলে মাছ শিকারে আবির্ভূত হয়। আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য”।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত এই উপাচার্য রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ’র অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ৭৯০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রেও নাম অর্জন করে নিয়েছিলেন। যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) অনুসন্ধান করে এবং ২০২১ সালের ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করেন শিক্ষকদের সংগঠন অধিকার সুরক্ষা পরিষদ। ওই সংবাদ সম্মেলনে সাবেক উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এবং অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনসহ জড়িত সকলের বিচারের দাবীও জানান।
অধিকার সুরক্ষা পরিষদের ওই সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকরা অভিযোগ তোলেন ২০১৭ সালের ১৪ জুন (বেরোবি) তে উপাচার্য হিসেবে ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ যোগদানের পর থেকে অনুপস্থিতি এবং অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জালিয়াতি, ভর্তি বাণিজ্য, হয়রানী, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং স্বেচ্ছাচারিতা করেছিলেন।
এছাড়াও তৎকালীন উপাচার্য নিয়ম বর্হিভূতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শুচিতা শারমিনকে চারটি বিভাগে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করেন। ওই সময় উপাচার্যের পিএস আমিনুর রহমানের ভায়রা ভাই মাহমুদুল হককে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়।
সোমবার অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে নিয়োগ নিশ্চিত হওয়ার পর এ প্রতিবেদক কথা বলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকদের সাথে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষকরা বলেন, আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর যে ফ্যাসিবাদী রাজত্ব কায়েম করেছিলো সমাজের সকল ক্ষেত্রে সেই ফ্যাসিবাদকেই জায়েজ করতে দেয়া বিবৃতিতে তার নাম থাকায় আমার কিছুটা অবাক হয়েছি। তাদের মতো কিছু শিক্ষকদের কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এতটা ন্যাক্কারজনকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছে। উক্ত বিবৃতিতে তিনিসহ অন্যরা যেভাবে ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সেটা আসলে গনতন্ত্রের জন্য বাধা হিসেবে প্রতিয়মান হয়েছে। বিগত শাসনের পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ বন্ধুকে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত করা ন্যায় সঙ্গত সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা সেটা ভেবে দেখা উচিত।
এবিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন এর মুঠোফোনে গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮ টায় একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুজয় শুভ জানান, বর্তমান উপাচার্যের অতীত ইতিহাস জানা নেই।

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED