Loading Now

ভোলায় লোকসান এড়াতে চুক্তিভিত্তিক ফার্মে ঝুঁকছেন ব্রয়লার খামারিরা

ভোলা প্রতিনিধি ।।

খামার করে অতীতে সংকটে পড়া ভোলার বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারি চুক্তিবদ্ধ ব্রয়লার ফার্মিংয়ে (সিবিএফ) যুক্ত হয়েছেন। এ ব্যবস্থায় খামারির আয় নিশ্চিত হয়েছে। তাদের সংসারে সচ্ছলতাও ফিরেছে। করোনা মহামারিতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলোও সিবিএফ সুবিধায় পুনরায় মুরগি উৎপাদনে ফিরেছে বলে জানিয়েছেন জেলার অধিকাংশ খামারি।

খামারিরা জানান, চুক্তিভিত্তিক খামার ব্যবস্থায় কম্পানি এক দিনের বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধসহ সব ধরনের উপকরণ খামারের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। মেয়াদ শেষে মুরগিও বিক্রি করে দেয়। মুরগির বাজার কম থাকলে কম্পানির লোকসান হলেও খামারিদের কোনো লোকসান বহন করতে হয় না।

‘চুক্তিভিত্তিক খামার হাঁস-মুরগি পালনকে নতুন জীবন দিয়েছে। এটি মানুষের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়াই অর্থ উপার্জনের সুযোগ তৈরি করেছে,’ চরফ্যাশন উপজেলার জনতা রোডের হাঁস-মুরগির উপকরণ ব্যবসায়ী নুরুন্নবী মিয়া (৪৬) ১৪ ডিসেম্বর এ কথা বলেন।

১০ হাজার মুরগির খামার পরিচালনাকারী এই ব্যবসায়ী জানান, চুক্তিভিত্তিক খামারিরা কম্পানি থেকে বিনা মূল্যে সব উপকরণের পাশপাশি পরিকল্পিত খামার গড়তে কারিগরি পরামর্শ পান। এ ছাড়া কখনো কখনো বাজারদর ভালো না থাকায় কম্পানি কম দামে মুরগি বিক্রি করলেও তাতে খামারিদের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। বরং চুক্তি অনুযায়ী লাভ পান।

যেহেতু কোনো পরিস্থিতিতেই উদ্যোক্তা ক্ষতির সম্মুখীন হন না, তাই যারা কখনো হাঁস-মুরগির খামার করার কথা ভাবেননি, তারাও সিবিএফ-এর খামারি হয়ে উঠছেন, তিনি আরো যোগ করেন।

বোরহানউদ্দিন উপজেলার বোরহানগঞ্জের মাহিয়া পোল্ট্রি ফিডসের স্বত্বাধিকারী আব্দুল মান্নান মোল্লা জানান, স্থানীয় ডিলারদের একটি অংশ উচ্চ মূল্যে উপকরণ বিক্রি করে মুরগি চাষিদের সুবিধা নিয়েছে, যার ফলে খামারিরা ঋণের জালে আটকে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘কাজী ফার্মের চুক্তিবদ্ধ খামার পোল্ট্রি ব্যবসাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে বর্তমানে এই দ্বীপজেলায় পর্যাপ্ত ব্রয়লার মুরগি পাওয়া যায়।

তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘ডিলারদের সঙ্গে ব্যবসা করাকালে একাধিকবার প্রতারিত হয়েছেন। একবার একজন ডিলার কৌশলে আমার কাছ থেকে একটি ফাঁকা চেক নিয়ে আমার বিরুদ্ধে ১২ লাখ টাকার মামলা করেছিলেন। পরে স্থানীয় সালিসের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পেরেছি।’

চরফ্যাশনের কাশেমগঞ্জের একটি মসজিদের সাবেক ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ ওয়াহিদ (৫৫) অতীত স্মৃতিচারণা করে জানান, ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিনি একে একে তিনজন ডিলারের সাথে ব্যবসা করেছিলেন। আর এরই মধ্যে খামারে লোকসানের কারণে ৬,০০,০০০ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন খামার বন্ধ করতে বাধ্য হলেও ঋণের দায় মেটাতে আমার ছেলেকে একজন ডিলারের দোকানে কাজ করাতে বাধ্য হয়েছি।

তিনি বলেন ‘২০২১ সালে চুক্তিবদ্ধ খামারে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কমিশনের টাকায় পরিবারের খরচ মিটিয়ে ডিলারদের অতীতের ঋণ পরিশোধ করছি। বর্তমানে আমার ৩,০০০ মুরগির খামার থেকে প্রতি ব্যাচে গড়ে ৮৮,০০০ টাকা পাচ্ছি।’

একটি ওষুধ কম্পানির বিপণন প্রতিনিধি চরফ্যাশনের দক্ষিণ আদর্শপাড়ায় চুক্তিবদ্ধ খামারি ইয়াকুব আলী (৪৫) তার ১,০০০ মুরগির খামার থেকে ১১টি ব্যাচে ৩,০০,০০০ টাকা লাভ করার তথ্য জানিয়ে বলেন, “ডিলারদের সঙ্গে পোল্ট্রি ব্যবসায় বেশির ভাগ খামারি ঋণেগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে চুক্তিবদ্ধ খামারে ঋণের কোনো মানসিক চাপ থাকে না। যে কারণে অদূর ভবিষ্যতে আমি ১০,০০০টি মুরগি সম্প্রসারণের স্বপ্ন দেখিছি।’

একই থানার হালিমাবাদের কৃষক ওহিদুল হক (৪৫) বলেন, ডিলাররা প্রায়ই কৃষকদের জন্য ঋণের ফাঁদ তৈরি করে। ‘আমি চুক্তিবদ্ধ খামারে যুক্ত হওয়ার পর থেকে লোকসান এবং ঋণের বোঝা থেকে চাপমুক্ত হয়েছি। কোনো টেনশন নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ৩,০০০ মুরগি পালন করে আমি ৯১,০০০ টাকা লাভ করেছি,’ তিনি উল্লেখ করেন।

জেলা সদরের কুঞ্জপট্টির প্রবাসফেরত তাজউদ্দিন (৪৯) দুই দফায় ডিলারদের সঙ্গে মুরগির খামার করে ১২ লাখ টাকা লোকসান গুনে ২০২১ সালে খামার গুটিয়েছিলেন। ২০২২ সালে সিবিএফ-এর আওতায় নতুন করে খামার শুরু করে এখন ৬,০০০ মুরগির শেড থেকে প্রতি ব্যাচে ২,৬৫,০০০ টাকা লাভ করছেন। ‘আমি আমার নিজের জমিতে ৫০,০০০ মুরগি পালনের জন্য বেশ কয়েকটি শেড স্থাপন করতে চাই,’ তিনি তার স্বপ্নের কথা বলেন।

ডিলার ও খামারিদের কাছ থেকে মুরগি সংগ্রহ করে পাইকারি বাজারে সরবরাহকারী ভোলার শশীভূষণের ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন (৩৪) বলেন, ‘সিবিএফ পোল্ট্রি ব্যবসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। সচেতন পুরনো খামারিদের পাশাপাশি নতুন অনেকে এ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। ফলে আগে এই দ্বীপজেলায় মুরগির চাহিদা ও উত্পাদনে যে ঘাটতি ছিল, তা পূরণ হয়েও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সরবরাহ হচ্ছে। ফলে এই ব্যবসায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমেছে।

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED