মডেল মেঘনার পরিবারের মাধ্যমে সুরাহার চেষ্টা করেছিল পুলিশ
বিনোদন ডেক্স ।।
বাংলাদেশ থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলানের একটি অনানুষ্ঠানিক অভিযোগের ভিত্তিতে মডেল ও অভিনেত্রী মেঘনা আলমকে আটক করেছে পুলিশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ আসার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশ মডেল মেঘনা আলমের সঙ্গে সৌদি রাষ্ট্রদূতের যোগাযোগের তথ্য পায়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনা আলমের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি জানতে পারে। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে মেঘনার পরিবারের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। মূলত এরপরই তাঁকে আটক করা হয়।
পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত মেঘনাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেন। মেঘনা এখন গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
মেঘনা আলমের ঘটনায় সামির নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি মেঘনা আলমের সহযোগী ছিলেন। ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মডেল মেঘনাকে আটকের দিনই ঢাকা ছাড়েন সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসামডেল মেঘনাকে আটকের দিনই ঢাকা ছাড়েন সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) অবশ্য গতকাল শুক্রবার এক বার্তায় দাবি করে, তাঁকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নেওয়া হয়েছে। মেঘনা আলমকে অপহরণ করা হয়েছে, এমন কথা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৃহস্পতিবার থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর ডিএমপি গতকাল ফেসবুকে বার্তাটি দেয়।
ডিএমপি বলছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের অবনতির অপচেষ্টা এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মেঘনা আলমকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সকল আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।
মেঘনা আলমকে অপহরণের অভিযোগ সঠিক নয়, এমন দাবি করে ডিএমপি বলছে, আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার তাঁর রয়েছে।
মেঘনা আলম ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত মিস আর্থ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। তিনি মিস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।
সৌদি ও বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি সূত্র সাংবাদিকদের বলেছে, রাষ্ট্রদূত ঈসা বাংলাদেশে তাঁর দায়িত্বের মেয়াদ প্রায় শেষ করে চলতি এপ্রিলে ঢাকা ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরই একপর্যায়ে সম্প্রতি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, একজন নারী ‘আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য’ তাঁর সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করছেন। তাঁকে বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছেন। রাষ্ট্রদূতের অভিযোগটি আমলে নিয়ে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনা আলমের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি জানতে পারে। পুলিশ মেঘনা আলমের পরিবারের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করে। তবে এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
একপর্যায়ে মেঘনা এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, কয়েকজন লোককে রাষ্ট্রদূত ঈসা পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়েছেন। তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়, সরকার রাষ্ট্রদূতের পক্ষে থাকবেন। তিনি যেন রাষ্ট্রদূতকে জড়িয়ে ফেসবুকে কিছু পোস্ট না করেন।
সৌদি রাষ্ট্রদূতের অভিযোগের ভিত্তিতেই মডেল মেঘনা কারাগারেসৌদি রাষ্ট্রদূতের অভিযোগের ভিত্তিতেই মডেল মেঘনা কারাগারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সৌদি রাষ্ট্রদূত গত বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বুধবার রাতেই রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে মেঘনা আলমকে আটক করা হয়। আটক হওয়ার আগে মেঘনা ফেসবুক লাইভে এসে অভিযোগ করেন, ‘পুলিশ পরিচয়ধারীরা’ তার বাসার দরজা ভেঙে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। প্রায় ১২ মিনিট ধরে চলা সেই লাইভে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং একাধিকবার সৌদি রাষ্ট্রদূতের কথা উল্লেখ করেন। তবে তাঁকে আটকের পরপরই ফেসবুক লাইভ বন্ধ হয়ে যায়। ভিডিওটি পরে তাঁর আইডিতে পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকজন ভিডিওটি ফেসবুকে শেয়ার করে।
ওই অভিযানে অংশ নেওয়া ভাটারা থানার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মেঘনা আলমকে আটকের জন্য বসুন্ধরা এলাকায় যাই। দরজা খুলতে তিনি অনীহা দেখান। পরে তাঁকে আটক করে মিন্টো রোডে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এদিকে রাষ্ট্রদূত ঈসা বুধবার দিবাগত রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি ঢাকায় যে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটি ব্যবহার করতেন, সেই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পাওয়া যায়নি।
মিস আর্থ বাংলাদেশ বিজয়ী মেঘনা আলম কারাগারেমিস আর্থ বাংলাদেশ বিজয়ী মেঘনা আলম কারাগারে
সরকার কর্মী পাঠানোসহ সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য গত জানুয়ারিতে রাষ্ট্রদূত ঈসাকে ‘বাংলাদেশ ডিপ্লোমেটিক এক্সিলেন্স মেডেল’ প্রদান করে।
সরকারি কয়েকটি সূত্র বলেছে, পুলিশ ও সরকারের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা দফায় দফায় মেঘনা আলমের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা বোঝার চেষ্টা করেন ঢাকায় বিদেশি কূটনৈতিক মহলে কার কার সঙ্গে তাঁর (মেঘনা) যোগাযোগ রয়েছে। সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর কোনো ভিডিও রয়েছে কি না।
এর বাইরে সৌদি আরবে বাংলাদেশের প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিকের উপস্থিতি, বড় শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গুরুত্বের দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রদূত ঈসার বিষয়টি থেকে তাঁকে (মেঘনা) সরে আসতে অনুরোধ করা হয়। তবে মেঘনা কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে রাজি না হওয়ায় পুলিশ তাঁকে আদালতে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পুলিশ বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মেঘনা আলমকে সোপর্দ করে। পুলিশের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেন। তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকেন, তবে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে আটক করে ওই কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা যায়। মেঘনা আলমের ক্ষেত্রেও সেই ভিত্তিতে পুলিশ আদালতের কাছে আবেদন করে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে—এমন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিকে সরকার বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক রাখতে পারে। একই আইনের ৩ (২) ধারায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনে এ ধরনের আদেশ কার্যকর হয়।
মেঘনা আলম ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’, কারণ জানাল পুলিশমেঘনা আলম ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’, কারণ জানাল পুলিশ
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, মানবাধিকার ও নারী অধিকারকর্মীরা বিদেশি একজন রাষ্ট্রদূতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মেঘনা আলমকে তাঁর বাসা থেকে আটক করা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে কারাগারে আটক রাখার নিন্দা জানান। তাঁরা অবিলম্বে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
Post Comment