মোহামেডান ক্লাবের মাঠে মসজিদের সাইনবোর্ড, এলাকায় উত্তেজনা
নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
বরিশালে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব মাঠে মসজিদের সাইনবোর্ড টানিয়ে টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হয়েছে একটি সংস্থার নামে। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। গতকাল সোমবার (১৭ নভেম্বর) রাতের কোনো এক সময় মুসলিম ইনস্টিটিউট জামে মসজিদের নামে সাইনবোর্ড ও একটি অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করা হয়।
আজ মঙ্গলবার ভোরে সেখানে ফজরের নামাজ আদায়ও হয়।
পরে জোহরের নামাজের সময় বিষয়টি স্থানীয়দের নজরে আসে।
এদিকে, ঘটনার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ক্লাবের একাধিক সাবেক নেতা মোহামেডান মাঠে যান। তাঁরা সেখানকার নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। মাঠের অভ্যন্তরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার রয়েছে।
শহীদ মিনার ঘেষেঁই রয়েছে বঙ্গবন্ধু অডিটরিয়াম নামের একটি মিলনায়তন। ২০১৪ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন এর নির্মাণকাজ শুরু করে। তবে কাজ সম্পন্ন না হওয়া এবং বিভিন্ন জটিলতার কারণে এটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
মুসলিম সোসাইটির সভাপতির পরিচয় দিয়ে অধ্যাপক আব্দুর রব দাবি করেন, মোহামেডান মাঠের জমিটি সোসাইটির মালিকানাভুক্ত।
তিনি বলেন, ‘সভাপতি হিসেবে এখানে মুসলিম ইনস্টিটিউট জামে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালনা করব। এ কারণে সোমবার রাতে মাঠের ভেতর ছোট একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করেছি। সেখানে ফজরের নামাজ আদায় করি। মঙ্গলবার দুপুরে মসজিদের সাইনবোর্ড টানানো হয় এবং জোহর নামাজও আদায় করা হয়।’
মসজিদ কমিটির সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সালাহউদ্দিন মাসুম বলেন, ‘মুসলিম সোসাইটির মালিকানাধীন স্টেটে মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে।
এখানে কারো বাধা দেওয়ার অধিকার নেই।’
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গভীর রাতে তৎকালীন সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ক্লাবটি ভেঙে দেন। পরে ক্লাবের পক্ষ থেকে আন্দোলন হয়। তবে সেই সময় মুসলিম সোসাইটি কেন দাবি উত্থাপন করেনি, এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত মাঠ ও ক্লাব রক্ষা কমিটির সদস্য ডা. মনীষা চক্রবর্তী মাঠ দখলের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন অবৈধভাবে ক্লাবটি ভেঙে ফেলেছিল। তখন আমরা উচ্চ আদালতে গিয়েছিলাম। আদালত রায়ে বলেছেন—উচ্ছেদ অবৈধ, এবং ক্লাবকে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সিটি করপোরেশনকে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যখন অবৈধ উচ্ছেদ হয়েছিল, তখন সোসাইটির নামে কোনো দাবি ছিল না। জমিটি ক্লাবের মালিকানায় বলেই আদালত আমাদের পক্ষে আদেশ দিয়েছেন। ফলে মাঠে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।’
স্থানীয়রা জানায়, যেখানে ঝুপড়ি ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছে, একসময় সেখানে ক্লাবের মূল ভবন ছিল। ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি গভীর রাতে বরিশাল সিটি করপোরেশন কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভবন ভেঙে ফেলে। ক্লাব সদস্যদের অভিযোগ, এটি ছিল ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাব ভেঙে দেওয়ায় ক্রীড়াঙ্গনে নেতিবাচক বার্তা যায় বলেও মন্তব্য তাঁদের।
ক্লাব পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি শফিকুল আলম গুলজার ওই সময় বলেন, ‘উচ্ছেদের নামে ক্লাবটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, আসবাব—কিছুই রক্ষা করা যায়নি। আমাদের কোনো নোটিশও দেওয়া হয়নি।’
ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহসান কবির হাসান উচ্ছেদের সময় বলেন, নিবন্ধিত ৩০০ সদস্যের ভোটে পরিচালনা কমিটি গঠনের বিধান থাকলেও ২০১৪ সালের পর নানা জটিলতায় নতুন কমিটি হয়নি। তিনি বলেন, বরিশালের এই ক্লাব একসময় বহু খ্যাতনামা ব্যক্তির সভাপতিত্বে পরিচালিত হয়েছে—যাঁদের মধ্যে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস, কর্মকর্তা লকিতুল্লাহ, বিডি হাবিবুল্লাহ থেকে শুরু করে বর্তমান বিসিবি পরিচালক আলমগীর হোসেন আলো।
মোহামেডান মাঠ ও ক্লাব রক্ষায় আন্দোলনও হয়েছে। ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি টাউনহল চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও মাঠ রক্ষা কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অ্যাড. আমিন উদ্দিন মোহন। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সদস্যসচিব নজরুল ইসলাম খান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ব্রিটিশ আমলে ‘জাতীয় জাগরণের প্রতীক’ হিসেবে বরিশাল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে জমিদার সৈয়দ ফজলে রাব্বীর দান করা ৩.৩০ শতাংশ জমিতে ১৯৪২ সাল থেকে ক্লাবের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। পরে দলিল ও বিএস খতিয়ানেও জমিটি ক্লাবের মালিকানা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
নেতারা জানান, ক্লাবটি প্রথমদিকে মুসলিম যুবকদের খেলাধুলার কেন্দ্র হলেও পরে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বরিশালের ক্রীড়াঙ্গনে এর অবদান দীর্ঘদিনের। ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অনুপ্রেরণায় কলকাতা মোহামেডানের সঙ্গে বরিশাল মোহামেডানের একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাব তৎকালীন সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ গুঁড়িয়ে দেন। সেই ক্লাব ও মাঠ রক্ষায় পরে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। তারাই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন।
তবে ক্লাব মাঠের সবশেষ অস্থায়ী ঘর ও সাইনবোর্ড টানানোর ঘটনার বিষয়ে সিটি করপোরেশন বা প্রশাসনের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্য পাওয়া যায়নি।



Post Comment