Loading Now

শেবাচিম হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট, নাজেহাল হচ্ছেন রোগী ও স্বজনরা

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥

শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট এর দৌরাত্মে প্রতিদিন নাজেহাল হচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। সরকারি এ্যাম্বুলেন্স এর অপর্যাপ্ততা এবং এর পরিচালনায় গড়িমসির কারনে বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের হাতে এখন জিম্মি হয়ে পড়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। ফিটনেসবিহীন শতাধিক এ্যাম্বুলেন্সের চালক ও এদের নিয়ন্ত্রন করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুযোগ বুঝে বাড়তি ভাড়া আদায়, রোগীর স্বজনদের সাথে অসদাচরন, বরিশালের বাইরে থেকে রোগী নিয়ে আসা এ্যাম্বুলেন্সের কাছ থেকে চাঁদা আদায় সহ নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরিশাল এ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে একটি সমিতির মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট চললেও বাস্তবে এই সমিতিতে দায়িত্বশীল কেই নেই। তবে সমিতির নামে যে যখন যেভাবে পারছে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে। বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে হাসপাতালের ভেতরে অদৃশ্য একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। তবে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নিয়মিত কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক। ইতিমধ্যে সকল এ্যাম্বুলেন্সের চলাচলের একটি সিরিয়াল নির্ধারন করে দিয়েছেন। ক্রমান্বয়ে সব অভিযোগের বিষয়গুলো আমলে নিয়ে নিয়ন্ত্রনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

সূত্র মতে, বর্তমানে শের-ই-বাংলা হাসপাতালে সরকারি ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এরমধ্যে রোগী পরিবহনের কাজে চলমান রয়েছে মাত্র ৫টি। বিকল অবস্থায় আছে ৭ টি। বাকি দুটি ঠিক রয়েছে তবে চালক না থাকায় তা এক রকম অকেজো অবস্থায় আছে। সরকারি এ সকল এ্যাম্বুলেন্স চালানোর জন্য চালক রয়েছে মাত্র ৪ জন। এদেরে মধ্যে দুজন এ্যাম্বুলেন্সের চালক হলেও তারা মেডিকেলের কর্মকর্তাদের গাড়ি চালান। তাই চলমান ৫ এ্যাম্বুলেন্সের জন্য মাত্র দুজন চালক কাজ করছেন। এদের বেশিরভাগ সময় খুঁজে পাওয়া যায়না। কোন মাধ্যম ছাড়া সাধারন রোগীরা এই সরকারি এ্যাম্বুলেন্সের সেবা নিতে পারেনা বললেই চলে। জরুরি বিভাগের সামনে এসকল এ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তা ঘিরে থাকে বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স চালক ও দালালরা। প্রতিদিন এই হাসপাতালে হাজারো রোগী পরিবহন সেবার প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে বেসরকারী এ্যাম্বুলেন্স চালকদের কাছে যাচ্ছে এবং নানা ধরনের হয়রানীর শিকার হচ্ছে। সঠিক সময়ে এ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স এর সেবা নিতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতাল কম্পাউন্ডে থাকা বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেওয়ার জন্য মেডিকেলের ভেতরে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। বর্তমানে বরিশাল এ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির আওতায় ঢাকাগামী ৩০-৩২ টি এবং বরিশালের অভ্যন্তরে চলার জন্য ৭০টির মত এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে শতাধিক এ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ফিটনেস নেই। পুরনো লক্কর ঝক্কর মাইক্রোবাসকে এ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে চালানো হচ্ছে বছরের পর বছর। এতে পরিবহনকালে রোগী সিট ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য আলাদা অনুমতি পত্র প্রয়োজন হলেও এরা শুধুমাত্র বিআরটিএ’র সাধারন যানের লাইসেন্স দিয়ে চলছে। একজন মুমূর্ষু রোগীর জন্য এই ধরনের এ্যাম্বুলেন্স প্রানঘাতী হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন মহল। ফিটনেসবিহীন এই এ্যাম্বুলেন্স গুলো প্রায়শই দূর্ঘটনার কারণ হচ্ছে। এই এ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগী এবং রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা দূর্ঘটনায় আহত হচ্ছে।
সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে রমরমা ব্যবসা ও নানা ধরনের স্বেচ্চাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের আগে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক আজিজুর রহমান শাহিনের নিয়ন্ত্রণে চলত শেবাচিমের বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা। বর্তমানে ছাত্রদল নেতা পরিচয়ে এই সিন্ডিকেট চালাচ্ছে শাহাদাৎ নামে একজন। তার সাথে রয়েছে সোহেল ও আজিজুল। এদের নেতৃত্বে বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স চালকরা প্রতিদিন রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। হাসপাতালের একটি সিন্ডিকেট প্রতি মাসে মাসোহারা পেয়ে থাকে বলে সরকারি এ্যাম্বুলেন্সে সংকট জিইয়ে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে একটি সমিতির মাধ্যমে ফিটনেসবিহীন অবৈধ গাড়িকে এ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে নিত্য নতুন ব্যবসায়ীও যুক্ত হচ্ছে। যে কারনে সরকারি এ্যাম্বুলেন্সের উন্নত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। ফলে অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি সঠিক সময়ে অ্যাম্বুলেন্স সেবা না পেয়ে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে। এদের বিরুদ্ধে বাইরে থেকে আসা এ্যাম্বুলেন্স থেকে ফিরতি ট্রিপ নেয়ার ক্ষেত্রে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।

 

ঢাকা থেকে রোগী নিয়ে আসা এ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, রোগী নিয়ে শেবাচিমে আসার পর একটি ফিরতি ট্রিপ ধরেছিলেন। রোগী নিয়ে যাওয়ার সময় এখানকার সিন্ডিকেটের লোকজন তাকে আটকে দেয়। এরপর রোগী নিতে পারবেনা বলে জানায়। বাধার মুখে রোগী রেখে চলে যেতে চাইলে তাতেও বাধা দেয় কয়েকজন। এর পর ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে যেতে হয় তাকে। ঝালকাঠী থেকে আসা রোগীর স্বজন মোস্তাক বলেন, ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক আমার রোগীকে ঢাকায় প্রেরণ করেছেন। কিন্তু সরকারি এ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে গলাকাটা ভাড়ায় বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্স নিতে হয়েছে। এতবড় হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স থাকবে না তা খুবই কষ্টকর বিষয়।

সচেতন নাগরিকদের ভাষ্য-শেবাচিম হাসপাতাল দক্ষিণাঞ্চলসহ আশপাশের জেলার মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল। সেখানে এ্যাম্বুলেন্সের সংকট মেনে নেওয়া যায় না। তাই অবিলম্বে এ সংকট দূর করার আহ্বান জানান তারা। পাশাপাশি এ সংকট তৈরির পেছনে জড়িত থাকা সিন্ডিকেট খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন।
অনুমোদনের বিষয়ে বরিশাল বিআরটিএ অফিসের একটি সূত্র জানায়, এ্যাম্বুলেন্সের কোন আলাদা লাইসেন্স নেই। সাধারন মাইক্রোবাসের লাইসেন্স নিয়ে এরা চলাচল করছে যা দন্ডনীয় অপরাধ। অন্যদিকে এদের যে ফিটনেস তাতে রোগী পরিবহন তো দূরের কথা সাধারন মানুষের চলাচলের জন্যও অযোগ্য।

এ ব্যাপারে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মশিউল মুনীর বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে হাসপাতালে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। সরকারি এ্যাম্বুলেন্সের ৫টি চলমান রয়েছে এবং তা রোগী পরিবহন সেবা দিচ্ছে। বেসরকারী এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে রোগী নেয়ার ক্ষেত্রে একটি সিরিয়াল নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ৪ টি করে এ্যাম্বুলেন্স ক্রমান্বয়ে রোগী তুলতে পারবে। কিছুদিন পূর্বে আনফিট কিছু এ্যাম্বুলেন্স চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে ফিটনেসবিহীন সব যানগুলোকে একটি ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। সিন্ডিকেট করে রোগী হয়রানী বা চাঁদা আদায়ের কোন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমার কিছুদিনের অনুপস্থিতিতে হাসপাতালের শৃঙ্খরা কিছুটা বিঘিœত হচ্ছে। খুব শীঘ্রই অস্থায়ী কর্মীদের যার যার স্থানে দায়িত্ব বণ্টন করা সহ সব ধরনের নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তিনি বলেন, সবাই এখানে পেটের দায়ে কাজ করতে আসে। তাই কারও কোন ক্ষতি না করে সব ধরনের অনিয়ম বন্ধ করা সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED