ট্রাম্পের গোল্ডেন ডোম: যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষাকবচ, নাকি মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার উসকানি
অনলাইন ডেক্স ।।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দেশের জন্য একটি আকাশ প্রতিরক্ষা প্রকল্পের প্রস্তাব করেছেন। নাম ‘গোল্ডেন ডোম’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ধেয়ে আসা যেকোনো হাইপারসনিক, ব্যালিস্টিক ও অত্যাধুনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে এটি তৈরি হচ্ছে। গত ২০ মে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘একবার পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে গোল্ডেন ডোম বিশ্বের অন্য প্রান্ত, এমনকি মহাকাশ থেকেও উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে সক্ষম হবে।’
তবে এমন একটি সর্বাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র (আকাশ) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হয়তো বাস্তবে সম্ভব নয়। কিছু বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন, এটি কাজ করলেও গোল্ডেন ডোম তৈরি হতে কমপক্ষে ১ দশক সময় লাগবে। এর জন্য খরচ হতে পারে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। একই সঙ্গে, এটি বৈশ্বিক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও মহাকাশের সামরিকীয়ানকেও ত্বরান্বিত করবে।
এই প্রকল্পের নাম ইসরায়েলের আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে অনুপ্রাণিত। আয়রন ডোম ভূমি থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তুলনামূলকভাবে কম দূরত্বের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করে। কিন্তু গোল্ডেন ডোমকে অনেক বড় একটি এলাকা কভার করতে হবে। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের আয়তনই ইসরায়েলের চেয়ে ৩৫০ গুণের বেশি। এ ছাড়া, আয়রন ডোম যে ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র/রকেটকে লক্ষ্য করে তৈরি সেগুলোর তুলনায় আরও ভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই গোল্ডেন ডোমের।
ট্রাম্প ও তাঁর কর্মকর্তাদের মতে, এই ব্যবস্থা বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে উৎক্ষেপিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, কম উচ্চতায় উড়ে আসা অত্যাধুনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং শব্দের পাঁচ গুণের বেশি গতিতে উড়তে ও কৌশল পরিবর্তনে সক্ষম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রও মোকাবিলা করতে পারবে। উল্লিখিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পারমাণবিক বা প্রচলিত বিস্ফোরক ওয়ারহেড বহন করতে পারে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এক বিবৃতিতে বলেছেন, গোল্ডেন ডোম হুমকি শনাক্ত ও প্রতিহত করতে ‘মহাকাশভিত্তিক সেন্সর ও আকাশ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা’ উভয়ই ব্যবহার করবে। রোড আইল্যান্ডের নেভাল ওয়ার কলেজের ডেভিড বারবাখ তাঁর ব্যক্তিগত মন্তব্যে নিউ সায়েন্টিস্টকে বলেছেন, এর মানে হলো ‘গোল্ডেন ডোমে’ একটি আমব্রেলা বা সর্বব্যাপী ব্যবস্থা থাকবে, যেখানে বিভিন্ন প্রযুক্তি বিভিন্ন হুমকি মোকাবিলা করবে।
তবে এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনো বাস্তবে নেই। জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির টমাস গঞ্জালেজ রবার্টস জানান, গোল্ডেন ডোম সম্ভবত লোয়ার অরবটি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে। এটি একটি নজিরবিহীন প্রযুক্তিগত অর্জন, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তাঁর স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে একই ধরনের একটি ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন। এর ডাকনাম ছিল ‘স্টার ওয়ার্স।’ ট্রাম্প গোল্ডেন ডোমকে ‘প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ৪০ বছর আগে যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা শেষ করার প্রচেষ্টা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা দূরপাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে পারাকে ‘অন্ধকারে বুলেট দিয়ে বুলেট আঘাত করার’ মতো কঠিন বলে বর্ণনা করেন। বারবাখ বলেন, কারণ এ ক্ষেত্রে আগত ‘লক্ষ্যবস্তু ছোট, দ্রুত গতিশীল এবং কোনো রেডিও বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ সংকেত বিচ্ছুরণ করে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, এমনকি আশাবাদী প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও ১০০ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে পারার সম্ভাবনা কম বলে স্বীকার করেন।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এরই মধ্যেই ভূমিভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রের একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটিকে আলাস্কায় মোতায়েন করা হয়েছে। বারবাখ বলেন, এগুলো ‘সর্বোচ্চ কয়েক ডজন আগত ওয়ারহেড গুলি করে নামাতে পারে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, রাশিয়া ও চীন তাদের ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও প্রতিহত করা কঠিন করতে পাল্টা ব্যবস্থা তৈরি করছে।
বারবাখ বলেন, ‘সাবসনিক (শব্দের চেয়ে কম গতির) ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বা মার্কিন সীমান্তের বাইরে থেকে উৎক্ষেপিত স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। তবে পুরো দেশ কভার করার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা ব্যয়বহুল হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসল চ্যালেঞ্জ হবে গোল্ডেন ডোমের লক্ষ্য। কারণ, ট্রাম্পের ঘোষণা অনুসারে, এটি চীন বা রাশিয়ার মতো দেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র শতভাগ আটকানোর চেষ্টা করবে।’
ট্রাম্পের দাবি, গোল্ডেন ডোম বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত, এমনকি মহাকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করবে। এর অর্থ হলো—এর জন্য ‘লোয়ার অরবিটালে সম্ভাব্য হাজার হাজার মহাকাশভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র ইন্টারসেপ্টরের একটি ঘন ক্ষেত্র প্রয়োজন হবে।’ রবার্টস বলেন, ‘এগুলো যেকোনো জায়গা থেকে উৎক্ষেপণের কয়েক মিনিটের মধ্যে কক্ষপথ থেকে নেমে এসে ক্ষেপণাস্ত্রকে আঘাত করতে পারবে।’
রবার্টস আরও বলেন, এটি নিশ্চিত করতে গিয়ে ‘যে পরিমাণ স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হবে, তা এখন পর্যন্ত উৎক্ষেপিত যেকোনো (স্যাটেলাইট কনস্টেলেশন) বা স্যাটেলাইট নক্ষত্র মণ্ডলের চেয়ে বড় হতে হবে।’ বর্তমানে, মহাকাশে সবচেয়ে বড় স্যাটেলাইট নক্ষত্র মণ্ডল স্পেসএক্সের এবং এটি প্রায় ৭ হাজার স্টারলিংক স্যাটেলাইট নিয়ে গঠিত।
ট্রাম্প গোল্ডেন ডোমের জন্য ১৭৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট প্রস্তাব করেছেন। যদিও এই তহবিল এখনো মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন পায়নি। কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের অনুমান, গোল্ডেন ডোমের মতো একটি মহাকাশভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর সিস্টেমের জন্য ৫৪২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্যাট্রিসিয়া বাজিলচিক বলেন, ‘১৭৫ বিলিয়ন ডলারের অঙ্কে কী কী ব্যয় অন্তর্ভুক্ত, তা স্পষ্ট নয়।’
ট্রাম্প আরও দাবি করেছেন যে, গোল্ডেন ডোম তার বর্তমান মেয়াদের শেষ নাগাদ অর্থাৎ ২০২৯ সালের প্রথম দিকে ‘পুরোপুরি কার্যকর’ হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা এটা সম্ভব বলে মনে করেন না। বাজিলচিক বলেন, ‘তিন বছরের সময়সীমা খুবই উচ্চাভিলাষী। এই উদ্যোগ সম্ভবত কমপক্ষে ১০ দশক, এমনকি তারও বেশি সময় ধরে চলবে।’
সময়সীমার অনেকটাই নির্ভর করবে এই প্রকল্প কতগুলো বিদ্যমান সামরিক ব্যবস্থা ব্যবহার করে তার ওপর। বাজিলচিক বলেন, ‘নতুন ইন্টারসেপ্টর, ওভার-দ্য-হরাইজন রাডার, মহাকাশভিত্তিক সেন্সর ও প্রযুক্তি প্রদর্শনীসহ স্বল্প মেয়াদে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব।’ কিন্তু গোল্ডেন ডোমের জন্য প্রয়োজনীয় হাজার হাজার স্যাটেলাইট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কত দ্রুত উৎক্ষেপণ করতে পারবে, তা নিয়ে বড় ধরনে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মহাকাশভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর প্রযুক্তি বিকাশের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল।
রবার্টস বলেন, ‘আমার মনে হয়, মাত্র তিন বছরে একটি বিশাল (স্যাটেলাইট) নক্ষত্র মণ্ডল স্থাপনের জন্য একটি উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্পেসএক্স মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে যেকোনো সংস্থার চেয়ে বেশি জিনিস বেশিবার উৎক্ষেপণ করে। এখানে চাওয়া হচ্ছে সেই ধারণাকেও আরও বাড়িয়ে দেওয়া।’
বারবাখ বলেন, ‘আমার মনে হয়, এত দ্রুত শতভাগ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে সক্ষম অর্থে একটি সিস্টেম পুরোপুরি কার্যকর হওয়া প্রায় অসম্ভব।’ তিনি আরও বলেন, ‘এত দ্রুত ছোট আকারের অপারেশনাল সক্ষমতা অর্জন করাও খুব কঠিন হবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এরই মধ্যে একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলমান। এই তিনটি দেশই নিজ নিজ পারমাণবিক অস্ত্রাগার আধুনিকীকরণ ও প্রসারিত করছে। একই সঙ্গে তাদের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মহাকাশভিত্তিক ব্যবস্থাও তৈরি করছে। বাজিলচিক বলেন, যদি গোল্ডেন ডোম ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা উন্নত করতে পারে, তবে এটি ‘কৌশলগত হিসেব-নিকেশও বদলে’ দিতে পারে। এর মাধ্যমে যেকোনো ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা থাকা প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাস কমে যাবে, যা তাদের হামলা চালানো থেকে বিরত রাখবে।
অন্যদিকে, রবার্টস বলেন, গোল্ডেন ডোমের ‘অস্থিতিশীলতায় অবদান রাখার আশঙ্কা’ আছে। অর্থাৎ, এটি কৌশলগত অস্থিতিশীলতাও তৈরি করতে পারে। কারণ এটি ‘আপনার পারমাণবিক প্রতিপক্ষকে এই সংকেত দেয় যে, আপনি তাদের বিশ্বাস করেন না।’ ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গোল্ডেন ডোমের ‘শক্তিশালী আক্রমণাত্মক ইঙ্গিত’ রয়েছে এবং এটি মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি বাড়াবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, গোল্ডেন ডোমের পরিকল্পনা রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারে।
বারবাখ বলেন, এই ব্যবস্থা মোকাবিলায় চীন ও রাশিয়া ‘মার্কিন স্যাটেলাইট ধ্বংস বা অকার্যকর করার চেষ্টা’ করতে পারে। উভয় দেশেরই স্যাটেলাইট ভূপাতিত করার মতো ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। তারা মার্কিন স্যাটেলাইট সিস্টেমে ইলেকট্রনিকভাবে জ্যাম বা হ্যাক করার চেষ্টা করতে পারে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সরকার সতর্ক করেছিল যে, রাশিয়ার কাছে মহাকাশ অস্ত্র উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা স্যাটেলাইট অকার্যকর বা ধ্বংস করতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত পারমাণবিক বিস্ফোরণ ব্যবহার করতে পারে রাশিয়া।
এই দেশগুলো তাদের ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগার বাড়াতে পারে এবং সম্ভবত আরও কৌশলী অস্ত্র তৈরি করতে পারে, যা মোতায়েন তো করা হবেই, প্রয়োজনে ব্যবহারও করা হতে পারে বলে মনে করেন বারবাখ। তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়া এরই মধ্যেই মহাকাশভিত্তিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা দিয়ে ঠেকানো যাবে না এমন অস্ত্র তৈরি শুরু করেছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি, আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক টর্পেডোর কথা বলেন, যা স্থল বা আকাশে নয়, পানির নিচে দিয়ে চলে।
সূত্র : আজকের পএিকা,,,,
Post Comment