Loading Now

ভিজিএফের চাল পৌঁছেনি দক্ষিণাঞ্চলের ৪ লাখ জেলের ঘরে

নিজস্ব প্রতিবেদক ।।

চারজনের সংসার আব্দুল জলিলের। মাছধরার বড় ট্রলারে সমুদ্রে থাকতে থাকতে শরীরটা নুব্জ্য হয়ে পড়েছে। ইচ্ছা ছিল নিষেধাজ্ঞার সময়ে বিশ্রামে থেকে ধকল কাটিয়ে উঠবেন। কিন্তু ঘরের চাল শেষ হয়ে যাওয়ায় শরীরের দিকে খেয়াল রাখতে পারেননি। গ্রামে দিনমজুরের কাজ নিয়েছেন।

বরিশাল সদর উপজেলার চরকরনজী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সরকারের তালিকায় নিবন্ধিত জেলে হওয়া সত্ত্বেও এখনো কোনো সহায়তা পৌঁছেনি তার ঘরে।

জলিল বলেন, ‘গেলবার মোর নামের চাল আরেকজনে উডায়ে নিয়া গ্যাছে। ভাবছেলাম চাল দুগ্গা পাইলে বাজার-সদাই কইরা টাইন্যা-মাইন্যা দিন কয়ডা পার হরমু। আর অইলো না। পেরায় চল্লিল দিন শ্যাষ, জাইল্যা কার্ডের চাল পামু কি নিষেধাজ্ঞা উইড্ডা গ্যালে।’

আব্দুল জলিলের আফসোসের সঙ্গে মিলে যায় ঝালকাঠি সদর উপজেলার জেলে মাহমুদের। মাঝবয়সী যুবক অবশ্য সরকারের তালিকায় নিবন্ধিত জেলে নন। মাহমুদ বলেন, ফিসারি অপিসে কয়ফির গ্যাছিলাম নামডা উডাইতে। মাস দুই টালবাহানার পরে আর পারি নাই। মোগো ফুল ফ্যামিলি জাইল্যা। কাম হইবে কি ফিসারিতো মোগো জাইল্যা কয় না।

বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল থেকে জানা গেছে, বিভাগের ছয় জেলায় নিবন্ধিত মোট জেলে চার লাখ ১৯ হাজার ২৮০ জন। প্রতিটি জেলায়ই নদী ও সমুদ্রগামী জেলে রয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র বরগুনা ও পিরোজপুরের কয়েকটি উপজেলায় জেলে সহায়তার ভিজিএফের চাল বিতরণ চলছে। বাকি ৪টি জেলায় চাল পৌঁছেনি।

সরকারের হিসেবে ৪ লাখের কিছু বেশি হলেও অনিবন্ধিত জেলে রয়েছে নিবন্ধিতের দেড়গুণ।

বিলম্বের পেছনে কি কারণ?

নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেই জেলা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নিবন্ধিত প্রতিজন জেলের অনুকূলে ৮৬ কেজি করে চাল বিতরণের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে প্রথম ধাপে ৫৬ কেজি ও দ্বিতীয় ধাপে ৩০ কেজি করে জেলেদের সহায়তা দেওয়া হবে। বরাদ্দ চাওয়া হলেও ১০ মে চাল বরাদ্দ হয় এবং তা জেলা পর্যায়ে এসে পৌঁছে ১৯ মে।

মৎস্য অফিসের দায়িত্বশীল দু’জন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জেলে চালের বিষয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সব উৎকণ্ঠা কাটিয়ে বরাদ্দ এসেছে। আগে চাল বিতরণ হতো স্থানীয় ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে। তাতে অধিকাংশ জেলেরাই সহায়তার আওতায় আসতো। এবার মেম্বার-চেয়ারম্যান না থাকায় প্রকৃত জেলের চেয়ে মৌসুমী জেলেরা তালিকায় ঢুকে পড়েছে বেশি। বিভিন্ন কারণে তারা অর্ন্তভূক্ত হয়েছেন বলেও জানান তারা। ফলে বিলম্বে বিতরণ হলেও প্রকৃত জেলেরা কতটুকু সহায়তার আওতায় আসবে তা নিয়ে সন্দিহান তারা।

আরেক কর্মকর্তা জানান, একমাস শেষ হলেও নিবন্ধিত জেলেদের প্রায় চারলাখ জেলের কাছে ভিজিএফের চাল পৌঁছেনি।

যা বলছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা

ঝালকাঠি জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা সাত হাজার ৮৪০ জন। এর মধ্যে সমুদ্রের জেলে ২৪০ জন। বিভাগের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই জেলায় জেলের সংখ্যা কম হলেও সহায়তার চাল বিতরণ করা যায়নি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, অবরোধ শুরুর পর একমাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে। আমরা বরাদ্দের চাল পাইনি দেখেই জেলেদের বিতরণ করতে পারিনি। চলতি সপ্তাহে আমরা বরাদ্দের চাল পেয়ে উপজেলা পর্যায়ে বন্টন করে দিয়েছি। আশা করছি এই সপ্তাহে প্রথম দফার সহায়তার চাল জেলেরা পাবে।

পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, জেলেদের সহায়তার চাল দ্রুত পৌঁছে দিতে আমি এবং জেলা প্রশাসক মহোদয় আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রচেষ্টা হলো এই সপ্তাহে সকল জেলেদের ঘরে চাল পৌঁছে দেওয়া। এই জেলায় নিবন্ধিত ৭৯ হাজার জেলে রয়েছে।

পিরোজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্যামত বলেন, আমরা চাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্টন শুরু করে দিয়েছি। এখনো পুরো তথ্য হাতে এসে পৌঁছেনি। তবে ধারণা করছি ইতোমধ্যে ২৮/৩০ শতাংশ চাল বন্টন হয়েছে। এই জেলায় ৩০ হাজারের বেশি নিবন্ধিত জেলে রয়েছে।

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, বরাদ্দের ভিজিএফ চাল এখনো এসে পৌঁছেনি। বরাদ্দ বুঝে পেলেই দ্রুত সময়ের মধ্যে তা জেলেদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এই জেলায় ৬৫ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছে।

বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর যা জানালো

জেলেদের সহায়তার চাল পৌঁছানোর বিলম্বের কারণ জানতে বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আলফাজ উদ্দীন শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আনিসুজ্জামান বলেন, জেলেদের দীর্ঘদিনের দাবি আমলে নিয়ে সরকার এবারই প্রথম ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে ৫৮ দিন সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে। নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তার অংশ হিসেবে চাল দেওয়ার কর্মসূচির প্রথম দফা চলতি সপ্তাহে সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি। মূলত আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে। বরাদ্দ বুঝে পেতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে বরাদ্দ আসার সঙ্গে সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট জেলা উপজেলায় পৌঁছে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সমুদ্রে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা ১৫ এপ্রিল থেকে হয়ে চলবে ২১ জুন পর্যন্ত।

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED