Loading Now

বস্তির ৮০ ভাগ পরিবারের বসবাস এক কক্ষে, ঋণ করে চলে ৯১ শতাংশ!

অনলাইন ডেক্স ।।

বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীগুলোর একটি রাজধানী ঢাকা। প্রায় দুই কোটি মানুষের ভারে নুয়ে পড়া এই মেগাসিটিতে প্রতিদিনই নতুন করে আসছে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর আবাসন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এখনো বাস করে বস্তিতে। অত্যন্ত নিম্নমানের পরিবেশে কোনো রকম মাথা গোজার ঠাঁই করে নেয় সমাজের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া স্বল্প আয়ের এই মানুষেরা।

ঢাকার বস্তিগুলোতে বসবাস করা লাখ লাখ মানুষ অনেক কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে। অত্যন্ত কম আয়ে চালাতে হয় তাদের সংসার। ফলে প্রায় ৯১ শতাংশ পরিবার ধারদেনা করে সংসার চালায়। ঋণে জর্জরিত এখানকার মানুষ। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কারণে তাদের রোগ-বালাই লেগেই থাকে সারা বছর। অথচ বস্তিগুলোতে নেই কোনো ক্লিনিক কিংবা চিকিৎসাব্যবস্থা। স্বাস্থ্যবুঁকিসহ নানা সমস্যা নিয়ে দিন কাটে এখানকার মানুষদের। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

আইসিডিডিআরবির তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে প্রায় পাঁচ হাজার বস্তি আছে। বস্তিতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বাস। বস্তিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০ হাজার মানুষ বাস করে। ৮০ শতাংশ পরিবার এক কক্ষের ঘরে থাকে। ৯০ শতাংশ পরিবার টয়লেট ও সরবরাহকৃত পানি ভাগাভাগি করে।

বস্তিতে নতুন নতুন সংকট

বর্তমানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে অবস্থিত বস্তিগুলো একাধিক নতুন সংকটে জর্জরিত। ‍জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) অনুযায়ী, ঢাকার মতো মহানগরীতে প্রতিদিন গড়ে ১৫০০ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে চলে আসছে, যার একটি বড় অংশ আশ্রয় নেয় বস্তিতে। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে বস্তিগুলোতে বসবাসের জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ছোট ছোট ঘরে অনেক পরিবার গাদাগাদি করে থাকায় গোপনীয়তা ও স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুৎ–এসব মৌলিক সেবা প্রায় প্রতিটি বস্তিতে সীমিত বা অনুপস্থিত। এর ফলে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও ডেঙ্গুর মতো রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের এক জরিপে দেখা যায়, বস্তির শিশুরা শহরের অন্য এলাকায় বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় তিন গুণ বেশি রোগাক্রান্ত হয়।

অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনও বস্তির সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিবৃষ্টি ও অস্বাভাবিক বন্যার কারণে নিচু এলাকায় গড়ে ওঠা বস্তিগুলোতে প্রায় প্রতি বছরই পানিবন্দি হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে কড়াইল, রেললাইন সংলগ্ন বা খালপাড়ের বস্তিগুলোতে ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, জীবিকা সংকটও এক বড় সমস্যা; অনেকেই দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল, যা কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) তথ্য অনুযায়ী, শহুরে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭%, যার একটি বড় অংশ বস্তিবাসী। এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ফাঁদে পড়ে অনেক কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি ও মানবপাচারের ঝুঁকিতে পড়ে। শিক্ষা ও নিরাপত্তার অভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দিন দিন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, যা সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক গভীর সংকেত।

দারিদ্র্য প্রকট, জীবনযাপনে করুণ চিত্র

বস্তি এলাকাগুলোতে দারিদ্র্যের চিত্র অত্যন্ত করুণ ও প্রকট। এসব স্থানে মানুষ অতি কষ্টে জীবন যাপন করে, যাদের অধিকাংশই দিনমজুর, রিকশাচালক কিংবা গৃহকর্মীর মতো অস্থায়ী ও স্বল্প আয়ের পেশায় নিযুক্ত। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হলেও উপার্জনক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা খুব কম। খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোর জোগান দিতেই তারা হিমশিম খায়। অনেক সময় এক চিলতে জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে হয়, যেখানে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই, পয়ঃনিষ্কাশনের অবস্থা শোচনীয় এবং রোগবালাই নিত্যসঙ্গী।

দারিদ্র্যের কারণে বস্তির শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। কারণ পরিবারগুলো অতিরিক্ত আয়ের জন্য শিশুশ্রমের ওপর নির্ভর করে। মেয়েরা অল্প বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে, ফলে সমাজে কুসংস্কার, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের মতো সমস্যারও বিস্তার ঘটছে। অনেক পরিবার ঋণের ফাঁদে পড়ে আরও দুর্দশায় নিপতিত হয়। সরকারের ও বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা সত্ত্বেও সমস্যাগুলো এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। বস্তির দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা জরুরি।

৯১ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত

বস্তি এলাকায় বসবাসরত মানুষের একটি বড় অংশ চরম অর্থকষ্টে দিন কাটায়। আইসিডিডিআরবি গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, বস্তির প্রায় ৯১ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে আছে। তাদের আয়ের পরিমাণ খুবই কম, কিন্তু দৈনন্দিন খরচ, চিকিৎসা, শিশুদের খাবার কিংবা ঘর ভাড়া মেটাতে গিয়ে তারা বাধ্য হয় ঋণ নিতে। কখনো স্থানীয় মহাজন, কখনো এনজিও, আবার কখনো আত্মীয়-স্বজন বা সুদের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা টাকা ধার নেয়। এসব ঋণ অনেক সময় অত্যধিক সুদে গৃহীত হয়, যার ফলে ঋণ শোধ করতে গিয়েই নতুন ঋণের প্রয়োজন পড়ে এবং তারা এক ভয়াবহ ঋণচক্রে আটকে পড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঋণগ্রস্ততা শুধু তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থাই নয়, সামাজিক ও মানসিক চাপকেও বাড়িয়ে তোলে এবং তারা ঋণের চাপে মানসিক নানা সমস্যায় ভোগেন। অনেক পরিবার মাসের শেষেই টানাটানিতে পড়ে যায়, কখনো খাবার কমিয়ে দেয়, কখনো সন্তানদের স্কুল থেকে উঠিয়ে আনে। কিছু মানুষ শ্রমের চেয়ে বেশি আয়ে পৌঁছাতে অবৈধ পথে পা বাড়ায়, যেমন চুরি, মাদক বিক্রি কিংবা নানা অপরাধে যুক্ত হওয়া। নারীরা অনেক সময় গৃহপরিচারিকার কাজের বাইরে গিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েন। ঋণগ্রস্ততা থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু সাময়িক সাহায্য নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান—যেমন সাশ্রয়ী ও সুদবিহীন ঋণপ্রাপ্তি, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ, স্থায়ী কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক সচেতনতা। তাহলেই বস্তিবাসী ধীরে ধীরে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে।

স্বাস্থ্যসেবার ভয়াবহ সংকট

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বসবাস করে, কিন্তু এসব এলাকায় পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৭৫ শতাংশ বস্তিতেই কোনো স্থায়ী বা অস্থায়ী ক্লিনিক নেই। সরকারি হাসপাতালগুলো দূরে হওয়ায় এবং বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর ব্যয় বহন করতে না পারায় অধিকাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন। শিশুদের টিকাদান, গর্ভবতী মায়েদের প্রাথমিক চিকিৎসা বা ডায়রিয়া, জ্বর, চর্মরোগের মতো সাধারণ সমস্যাগুলোর জন্যও তারা ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নিতে বাধ্য হন।

‘বস্তি এলাকার ৮২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অব্যবস্থার কারণে বস্তিবাসীদের মধ্যে রোগ ছড়ানোর হার অনেক বেশি। ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বস্তিতে বসবাসকারীদের ৬৫ শতাংশই বছরে অন্তত একবার অসংক্রামক রোগে ভোগেন, অথচ সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় তা জটিল আকার ধারণ করে। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি করপোরেশনগুলো যদিও কিছু অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করে থাকে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে বস্তিগুলোতে স্থায়ী ক্লিনিক স্থাপন এখন সময়ের দাবি।

জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবির গবেষক ড. মোস্তফা মাহফুজ বলেন, ‘বস্তিতে স্বল্প আয়ের মানুষ থাকেন। বস্তিগুলো ঘনবসতিপূর্ণ ও নোংরা পরিবেশ। রিকশা চালক, ভ্যানচালক ও শ্রমিক-শ্রেণি থাকে। আর বস্তিতে বড় সমস্যা হলো স্বাস্থ্যসেবা। এই মানুষগুলো স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গ্রামের মানুষ অসুস্থ হলে যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা হাসপাতালে। আর বস্তিগুলো লাখ লাখ মানুষ থাকে, তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা।’

এই গবেষক বলেন, ‘বস্তির নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী, তারা পুষ্টিতে ভোগেন। তারা শিক্ষাতেও পিছিয়ে। স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কেও অসচেতন। বস্তিগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে। তাদের এগিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’

ড. মোস্তফা মাহফুজ বলেন, ‘দেশের পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা উভয় দিক থেকে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সবার মাঝে সচেতনতার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। সেইসঙ্গে তাদের সমস্যা কী বা চাহিদা কী সেটাও দেখতে হবে, চাহিদার আলোকে পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করতে হবে।’

আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ও পুষ্টিবিদ তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন হচ্ছে। শহরের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে। স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মাঝখানে থাকা বস্তিবাসী নানা সেবা থেকে বঞ্চিত। বস্তির মানুষের জীবনমান খারাপ।’

করোনায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শহুরে নারী কর্মীরা, ঋণে জর্জরিত ২৮%

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘বস্তির উন্নয়নের সরকারকে কাজ করতে হবে। তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। যারা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন, তাদের স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বস্তির অনেকে অসচেতন, তারা জানেনও না কখন তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিতে হবে। রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে তাদেরও এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। কেউ এগিয়ে যাবে আর কেউ পিছিয়ে থাকতে, তাহলে তো হবে না। সবার স্বাস্থ্য আর শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব কায়সার বলেন, ‘বস্তির মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া নানা কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জীবিকার সন্ধানে মানুষজন নগরে এসে বস্তিতে আশ্রয় নেন। এজন্য প্রথমেই গ্রাম উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। গ্রামের মানুষকে বিনা কারণে শহরে আসা বন্ধ করতে হবে।’

মাহবুব কায়সার বলেন, ‘বস্তি টিকিয়ে রাখেন রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা তাদের স্বার্থে। সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে। নিম্ন-আয়ের মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে নজর দিতে হবে।’

তথ্য সূত্র : ঢাকা মেইল,,,,,,

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED