Loading Now

হাসপাতালের মেঝেতে ৪৪ লাখ রোগী!

অনলাইন ডেক্স ।।

সারা দেশের হাসপাতালের মেঝেতে প্রতিদিন ১২ হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। সেই হিসাবে বছরে মেঝেতে চিকিৎসা নেয় প্রায় ৪৪ লাখ রোগী।

এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও শয্যার অভাবে দিনে আরো কয়েক হাজার রোগী ভর্তি হতে পারে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দিনে গড়ে দুই হাজার রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নেয়। একই চিত্র ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও।

এর বাইরে বিভাগীয় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গড়ে এক হাজার ৫০০ রোগী এবং অন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে গড়ে এক হাজার রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নেয়। দেশে গত পাঁচ বছরে সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

এতেও শয্যাসংকট কাটছে না।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেছেন, দিনে ১৫ হাজার মানুষ হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নেয়। সেই হিসাবে বছরে মেঝেতে চিকিৎসা নেয় প্রায় ৫৪ লাখ ৩৫ হাজার রোগী। শয্যার অভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে না আরো অন্তত ১০ লাখ রোগী।

অধ্যাপক ডা. সায়েদুর মনে করেন, আরো ১৫ হাজার শয্যা বাড়ানো ছাড়া মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য অতিদ্রুত ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও তা বাস্তবায়নে তিন থেকে পাঁচ বছর লাগবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অন্তত ২০টি জেলায় প্রতি ১০ হাজার বাসিন্দার জন্য স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে গড়ে দুটি শয্যাও বরাদ্দ নেই। এর মধ্যে শেরপুরে সবচেয়ে কম—১.৩০। লক্ষ্মীপুরে ১.৪৪, পরের অবস্থানে নরসিংদী ১.৪৯, হবিগঞ্জে ১.৫০, গাজীপুরে ১.৫৬, সিরাজগঞ্জে ১.৫৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১.৬১, নাটোরে ১.৬২, গাইবান্ধায় ১.৬৩ ও চুয়াডাঙ্গায় ১.৬৬।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুর্বল প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার অভাবে জীবনহানি, রোগ বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে শয্যা বাড়ানো কোনো সমাধান নয়। কারণ কোথাও শয্যা ফাঁকা থাকছে, কোথাও শয্যাসংকটে মেঝেতেও রোগীর জায়গা হচ্ছে না। এতে চিকিৎসা নিতে এসে রোগী ও রোগীর আত্মীয়রা সংক্রমিত হচ্ছেন। বাদ পড়ছেন না চিকিৎসক ও নার্সরাও। তাই প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও প্রাথমিক সেবায় জোর দিতে হবে।

২০২২ সালের হেলথ বুলেটিনের (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা এমআইএসের বার্ষিক প্রতিবেদন) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ৭১ হাজার ৬৬০টি। বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৯৯ হাজার ৯৭৫টি। মোট শয্যা এক লাখ ৭১ হাজার ৬৭৫টি।

এক রোগী থেকে অন্যজনে সংক্রমণ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালের করিডর বা মেঝেতে থাকা রোগীদের রোগজীবাণুতে সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কারণ করিডর বা মেঝে ফাঁকা না থাকায় বেশির ভাগ সময় জীবাণুমুক্ত করা হয় না। এতে এক রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অন্য রোগ নিয়ে বাড়ি ফিরছে রোগী। এতে অধিক সময় হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনফেকশন কন্ট্রোল কমিটির সদস্যসচিব ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার বলেন, করিডর বা মেঝেতে থাকা রোগী নানাভাবে জীবাণু দ্বারা সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। স্বাস্থ্যকর্মী ও দর্শনার্থীর সংক্রমিত হাত এবং কাছাকাছি থাকা রোগীদের মধ্যে সরাসরি সংস্পর্শ, সংক্রমিত মেঝের কাছাকাছি থাকা এবং সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত না হওয়া ট্রলি, চেয়ার বা সরঞ্জাম থেকে হাসপাতালে থাকা (নোসোকোমিয়াল ইনফেকশন) জীবাণু (এমআরএসএ, ইএসবিএল) সহজেই সংক্রমণ ঘটায়।

অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার বলেন, করিডরে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ভালো না থাকায় শ্বাসতন্ত্রের জীবাণু সহজেই এক রোগী থেকে অন্য রোগীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার হাসপাতালের এসব জীবাণু প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়, ফলে এদের গুরুতর ইনফেকশন, আইসিইউ সাপোর্ট এবং মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। রোগীর নিরাপত্তা এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে এই প্রথা দ্রুত বন্ধ করা জরুরি।

প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা জরুরি : স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সারা দেশে সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২১ হাজার ৪১১টি। এর মধ্যে রোগী ভর্তির সুবিধাসহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল আছে ৬৬০টি। দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা সাত হাজার ৮৫৪টি এবং বেসরকারি রোগ নিরীক্ষাকেন্দ্র প্রায় ১০ হাজার। ব্লাড ব্যাংক ১৮০টি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, অতীতে বাংলাদেশ কিছু রোগ নির্মূল করেছে, কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এর মধ্যে ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, জলাতঙ্ক রয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে।

তিনি বলেন, চিকিৎসাব্যবস্থা তিন স্তরের হওয়া জরুরি। যেমন—৮০ শতাংশ মানুষকে ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। জেলা পর্যায়ে ৯৫ শতাংশ মানুষের সেবা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া গুরুতর ৫ শতাংশ রোগী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেবে। তবেই শয্যার সংকট কমবে।

প্রতিদিন ১৫ লাখ রোগীর চিকিৎসা : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে হাসপাতালের সাধারণ শয্যাসংখ্যা ৩৫ হাজার থেকে প্রায় ৭২ হাজার হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতাল ৫০ থেকে ২৫০ শয্যা এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য সব হাসপাতালে শয্যা বেড়েছে। আইসিইউ শয্যাসংখ্যা ৩৮১ থেকে এক হাজার ৮৬০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ উপজেলা হাসপাতালে সারা বছরই শয্যা ফাঁকা থাকছে। বেশির ভাগ রোগীর চাপ তৈরি হচ্ছে বড় শহর ও ঢাকার হাসপাতালগুলোতে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ঢাকাকেন্দ্রিক। সারা দেশের রোগী ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসে। অথচ উপজেলা হাসপাতালে বেশির ভাগ সময় শয্যা ফাঁকা থাকছে। কোনো রেফারেল পদ্ধতি নেই। এখানে পরবির্তন জরুরি। প্রথমে আমাদের কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে বেশি জোর দেওয়া জরুরি। এরপর মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা ও তৃতীয় পর্যায়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গুরুত্ব পাচ্ছে না: অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করে দেওয়া স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মনে করেন কমিশনের সদস্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ৭০ শতাংশ সেবা বেসরকারি খাতে চলে গেছে। বিষয়টি থেকে জাতিকে রক্ষা করতে অবশ্যই সরকারি খাতের গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাগুলোকে কতগুলো অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না।

সূত্র : বাংলা নিউজ,,,

Post Comment

YOU MAY HAVE MISSED